টিনিয়াসিস রোগ কী? ফিতাকৃমি যে রোগ ছড়ায়!

টিনিয়াসিস রোগ কী? ফিতাকৃমি যে রোগ ছড়ায়!

টিনিয়াসিস রোগ টি সারা বিশ্বেই কমবেশি দেখা যায়। একজাতীয় পরজীবী কৃমি এই রোগের জন্য দায়ী।এটি একটি নিরব ঘাতক রোগ। বেশিরভাগ সময় এই রোগ নিরবে লক্ষণ প্রকাশ না করেই লিভার সহ মস্তিষ্কের মারাত্বক ক্ষতি করতে পারে।তাই আসুন নিজে ও পরিবারকে বাঁচাতে টিনিয়াসিস রোগ সম্পর্কে জানি।

টিনিয়াসিস রোগ কী? ফিতাকৃমি যে রোগ ছড়ায়!

আপনি আরও পড়তে পারেন … পরজীবীঘটিত ডায়রিয়া কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!কালাজ্বর কী? কালাজ্বর এর লক্ষণ ও প্রতিরোধ!

টিনিয়াসিস কী?

টিনিয়া গণের ফিতাকৃমির দ্বারা যে রোগ সৃষ্টি হয় তাকে টিনিয়াসিস বলে।

টিনিয়াসিস রোগ এর কারণ কী?

সাধারণত দুই ধরনের পরজীবীর মাধ্যমে টিনিয়াসিস হয়ে থাকে। এদের নাম হলো টিনিয়া সোলিয়াম এবং টিনিয়া স্যাজিনেটা।এ-দু’টি পরজীবী দেখতে একই রকম এবং এদের জীবনচক্রও প্রায় একই ধরনের।

টিনিয়াসিস রোগ কোন পোাণির মাধ্যমে ছড়ায়?

টিনিয়া সোলিয়াম বহনকারী প্রাণী হচ্ছে শুকর আর টিনিয়া স্যাজিনেটা বহনকারী প্রাণী হচ্ছে গরু।

মুসলমানদের টিনিয়াসিস রোগ কম হয় কেন?

টিনিয়া সোলিয়াম বেশি দেখা যায় মধ্য ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার কিছু অংশে আর টিনিয়া স্যাজিনেটা বেশি দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়া, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশসমূহে। মুসলমান অধ্যূষিত দেশসমূহে টিনিয়া সোলিয়াম তেমন দেখা যায় না, কারণ মুসলমানেরা শুকরের মাংস খায় না।

ফিতাকৃমির গঠন

ফিতাকৃমি ছবি ফিতাকৃমির দেহের গঠন

প্রাণীজগতে ১০টি পর্ব আছে। এর মধ্যে প্লাটি হেলমিনথিস একটি পর্ব। টিনিয়া পরজীবীরা এই পর্বের মধ্যে পড়ে। এরা বৃহত্তম পরজীবী, যা দৈর্ঘ্যে ১২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। টিনিয়া পরজীবীর মাথা মোটা এবং দেহ খণ্ডায়িত প্রতিটি খণ্ড ডিম তৈরি করে।

ফিতাকৃমি কিভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করে?

টিনিয়া পরজীবী বহন করছে এমন গরু বা শুকরের মাংসে কৃমির বাচ্চা বা লার্ভা থাকে। এসব গরু বা শুকরের মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ না করা হলে লার্ভা মরে না। কৃমির লার্ভা আছে এমন মাংস অসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ অবস্থায় কোনো মানুষ গ্রহণ করলে লার্ভা তার অন্ত্রে চলে যায় এবং সে টিনিয়াসিসে আক্রান্ত হয়।

ফিতাকৃমি যেভাবে দেহে প্রবেশ করে

সময়ের সাথে সাথে এই লার্ভা পূর্ণ কৃমিতে পরিণত হয় এবং ডিম পাড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির মলের সাথে কৃমির ডিম বাইরে এসে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সেই পরিবেশে জন্মানো ঘাস বা লতাপাতা খেয়ে গরু বা শুকর যখন ডিমটি গ্রহণ করে তখন সেটি তাদের অন্ত্রে চলে যায়।

এরপর লার্ভা বের হয়ে অস্ত্রের দেওয়াল ভেদ করে রক্ত অথবা লসিকানালীর মাধ্যমে মাংসপেশীতে চলে যায়।
এভাবে আবার যখন কোনো মানুষ সেই গরু বা শুকরের মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ না-করে খায় তখন সে টিনিয়াসিস রোগ এ আক্রান্ত হয়।

টিনিয়াসিস রোগ এর লক্ষণ ও উপসর্গ

টিনিয়াসিসে আক্রান্ত হলে তেমন কোনো উপসর্গ বোঝা যায় না। এই রোগ নীরবে ক্ষতি করে।তবে সাধারণত নিচের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে-

  • কেউ কেউ পেটে অস্বস্তি বা ব্যথার কথা বলে।
  • অনেকের দীর্ঘদিন ধরে বদহজম দেখা দিতে পারে।
  • তবে, অনেক সময় পায়খানার সাথে কৃমির অংশ নির্গত হয়, যা দেখে টিনিয়া-র অস্তিত্ব ধরা যায়।
  • টিনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির পুষ্টিতে ভাগ বসায় এবং দীর্ঘদিন শরীরে থেকে অনেক ক্ষতি করে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তি মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগে এবং ক্রমেই শুকিয়ে যেতে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে টিনিয়াসিস মস্তিষ্কে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

টিনিয়াসিস রোগের জটিলতা

সঠিকভাবে টিনিয়াসিসের চিকিৎসা করা না হলে এ রোগ বেশি জটিল আকার ধারণ করতে পারে এবং এই কৃমি মস্তিষ্ক, চোখ বা হৃদপিণ্ডের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়াও, টিনিয়াসিসের কারণে অস্ত্রে প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি হতে পারে।

ফিতাকৃমির আক্রমণ কিভাবে বুঝবেন?

টিনিয়াসিস রোগ নির্ণয় করা সহজ। আক্রান্ত ব্যক্তির মল পরীক্ষা করলে টিনিয়া সোলিয়াম বা টিনিয়া স্যাজিনেটার ডিম সনাক্ত করা যায়। অনেকসময় টিনিয়া-র সেগমেন্ট বা খণ্ডও দেখা যায়। রক্ত পরীক্ষা করলে ইসোনোফিল বেশি পাওয়া যায়। কিছুকিছু ক্ষেত্রে কৃমি থেকে সিস্ট হয়ে ক্যালসিফাইড হয়ে যায়। তখন এক্সরে বা সিটি স্ক্যানের প্রয়োজন হতে পারে। তবে, সাধারণত এসব পরীক্ষার দরকার পড়ে না।

টিনিয়াসিস রোগের ঔষধ ও চিকিৎসা

টিনিয়াসিসের ভালো চিকিৎসা আছে। প্রাজিকুয়ান্ট্যাল নামের একটি ওষুধ এ-রোগে ভালো কাজ করে। এছাড়াও, এলবেনডাজল এবং নিকলোসোমাইড ওষুধও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কার জন্য কোন ওষুধ উপযুক্ত তা একজন চিকিৎসকই ঠিক করবেন।

মস্তিষ্কে সংক্রমণ হলে খিঁচুনি দূর করার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। অনেক সময় টিনিয়াসিস থেকে হাইড্রোসেফালাস হয়, অর্থাৎ মস্তিষ্কে পানি জমে। সেক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।তবে, খুব কম ক্ষেত্রেই এমন ঘটে।

টিনিয়াসিস রোগ ও ফিতাকৃমি প্রতিরোধের উপায়

ছয়মাস পরপর সবার কৃমির ওষুধ খাওয়া উচিত।তা না হলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। টিনিয়াসিস সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। তবে, আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করাতে পারলে সে নিজে দ্রুত সেরে উঠবে এবং অসুখটিও আর ছড়াতে পারবে না।নিচের সতর্কতাগুলো অবলম্বন করলে টিনিয়াসিস সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

  • মাংস রান্না করার সময় ভালোভাবে সিদ্ধ করতে হবে।
  • অসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ মাংস খাওয়া যাবে না। রাস্তাঘাটে মাংস খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
  • খাবার আগে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। স্যানিটারি ল্যাট্রিন বা স্বাস্থ্যকর পায়খানা ব্যবহার করলে কৃমির ডিম সহজে পরিবেশে ছড়াতে পারে না।
  • বসতবাড়ির পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে টিনিয়াসিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা যায়।
  • সবার সচেতনতাই এ-রোগ প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।

লেখক
ডা. মো: ফজলুল কবির পাভেল
পাবনা মেডিকেল হাসপাতাল