ফিস্টুলা কী?প্রসবজনিত ফিস্টুলার কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

ফিস্টুলা কী?প্রসবজনিত ফিস্টুলার কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোতে প্রসবজনিত ফিস্টুলা (obstetric fistula) একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে বিপুলসংখ্যক মা কোনো চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াই সন্তান প্রসব করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘অবহেলিত অবস্থায় সন্তান প্রসবের সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব বলে অভিহিত করেছে, যার শিকার হচ্ছেন বিশ্বের প্রায় ২০ লক্ষ মহিলা। এই সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে।

ফিস্টুলা কী?প্রসবজনিত ফিস্টুলার কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

আপনি আরও পড়তে পারেন …… একলাম্পসিয়া কী?একলাম্পসিয়ার কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা! …… গর্ভকালীন ডায়াবেটিস!গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!

ফিস্টুলা কী?

ফিস্টুলা হলো যোনি এবং মূত্রথলি অথবা যোনি এবং পায়ুপথের মধ্যবর্তী অংশে সৃষ্ট একটি অস্বাভাবিক ছিদ্র। যোনি ও মূত্রথলির মধ্যবর্তী জায়গায় এ ধরনের ছিদ্র সৃষ্টি হলে তাকে ভেসিকো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা এবং যোনি ও পায়ুপথের মধ্যে সৃষ্ট ছিদ্রকে রেক্টো ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা বলা হয়ে থাকে। এজাতীয় সমস্যা হলে যোনির ভেতরে প্রস্রাব ও মল প্রবেশের পথ তৈরি হয় এবং এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে সবসময়ই প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়ায়।

কীভাবে ফিস্টুলা হয়?

কোনো প্রতিবন্ধকতার ফলে প্রসব দীর্ঘায়িত হলে প্রসূতি মা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যেতে পারেন, এমনকি মায়ের মৃত্যুও হতে পারে। দীর্ঘায়িত প্রসব সারাবিশ্বের প্রায় পাঁচ লক্ষ মাতৃমৃত্যুর আট শতাংশের জন্য দায়ী। এ-অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা বা সিজারিয়ান ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ না-থাকলে মৃতশিশু প্রসব, নবজাতকের মৃত্যু অথবা মায়ের শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিতে পারে বা মৃত্যুও হতে পারে।

কীভাবে ফিস্টুলা হয়?

দীর্ঘায়িত প্রসবের সময় যখন প্রসূতি শিশুর জন্ম দিতে চেষ্টা করেন এবং শিশুর মাথা অনবরত মায়ের পেলভিক হাড়ে চাপ দিতে থাকে তখন যোনি ও মূত্রথলি ফলে সৃষ্ট ক্ষত, প্রজননতন্ত্রের ক্যান্সার ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট রেডিওথেরাপি এবং গর্ভাবস্থায় ও প্রসবকালীন জরুরী অবস্থায় উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব অন্যতম।

প্রসবজনিত ফিস্টুলার প্রভাবসমূহ

ফিস্টুলার প্রভাবসমূহ

ফিস্টুলার শারীরিক প্রভাব

দীর্ঘায়িত প্রসবের ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম থাকে এবং প্রসূতি মা নিজে বেঁচে গেলেও তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় ও ফিস্টুলা দেখা দিতে পারে।

ফিস্টুলার ফলে যোনিপথে মলমূত্র এসে সার্বক্ষণিক অস্বস্তির সৃষ্টি করে। অনেকসময় দীর্ঘায়িত প্রসবের ফলে ‘ফুট ড্রপ’-নামক একধরনের শারীরিক অক্ষমতার সৃষ্টি হয়।এরকম অবস্থায় কোনো মহিলার নিম্নাঙ্গের স্নায়ুর ক্ষতির ফলে তিনি হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ফিস্টুলা যৌনাঙ্গে আলসার বা ঘায়ের সৃষ্টি করতে পারে।

সঠিকভাবে চিকিৎসা করা না হলে আলসার এবং সংক্রমণের ফলে কিডনির রোগ হতে পারে এবং কিডনি বিকল হয়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

প্রসবজনিত ফিস্টুলার সামাজিক প্রভাব

শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি ফিস্টুলার কারণে আক্রান্ত মহিলাকে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ফিস্টুলার জন্য একজন মহিলাকে তাঁর স্বামীর কাছে হেয় হতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটতে পারে।

ফিস্টুলার ফলে সৃষ্ট দুর্গন্ধের কারণে আক্রান্ত মহিলাকে সবসময় লজ্জার মধ্যে থাকতে হয়। সবাই তাঁকে অপরিচ্ছন্ন ও অপবিত্র বলে মনে করে এবং এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সন্তান গ্রহণে অক্ষম হয়ে পড়েন।

ফিস্টুলা আছে এমন মহিলাদেরকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অস্পৃশ্য জীবনযাপন করতে হয়। তাঁরা বিষণ্ণতায় ভোগেন এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে।এধরনের মহিলাদের মধ্যে অনেকসময় আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।সমাজবহির্ভূত হয়ে এবং কাজের সুযোগ হারিয়ে অনেক মহিলা ভিক্ষাবৃত্তি বা যৌনপেশায় জড়িয়ে পড়তে পারেন।

কাদের ফিস্টুলা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি

সাধারণত কমবয়সী এবং দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে ফিস্টুলা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। ফিস্টুলার ঝুঁকি যাঁদের সবচেয়ে বেশি তাঁরা হলেন:

  • অল্পবয়সী মহিলা।
  • যেসব মহিলার দু’বার গর্ভধারণের মাঝে খুব কমসময়ের ব্যবধান থাকে।
  • যারা প্রথমবারের মতো সন্তান জন্ম দিচ্ছেন।
  • যেসব মহিলার শারীরিক বৃদ্ধি অপুষ্টি বা শৈশবকালীন কোনো অসুস্থতার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আছে।
  • যারা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন।
  • যারা যথাযথ প্রসবকালীন সেবা গ্রহণ না-করে বাড়িতে সন্তানের জন্ম দেন।

এছাড়াও, যেকোনো বয়সের মহিলার কোনো একটি সন্তান জন্মদানের সময় প্রসব বাধাগ্রস্ত বা দীর্ঘায়িত হলে এবং প্রসূতি তাৎক্ষণিকভাবে যথোপযুক্ত চিকিৎসাসেবা না পেলে ফিস্টুলা হতে পারে।

প্রসবজনিত ফিস্টুলার ফিস্টুলার চিকিৎসা

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পুনর্গঠন

অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফিস্টুলাবিশিষ্ট স্থানটির পুনর্গঠন সম্ভব, কিন্তু সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞ শল্যচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং এসব ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের পর রোগীর উপযুক্ত সেবাযত্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

অভিজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারা মানসম্মত চিকিৎসা-সরঞ্জামের সাহায্যে অস্ত্রোপচারে অপেক্ষাকৃত কম জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগ সাফল্য লাভ করা যায় এবং বেশি জটিল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার শতকরা ৬০ ভাগ হয়ে থাকে।

অস্ত্রোপচার সফল হলে মহিলারা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন এবং পুনরায় সন্তান গ্রহণ করতে পারেন। তবে, সেক্ষেত্রে যেন ফিস্টুলার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য সিজারিয়ান অপারেশনের সাহায্যে শিশুর জন্ম দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

কিছু মহিলার অবস্থা অস্ত্রোপচারের অনুকূলে থাকে না—তাঁদের জন্য ইউরোস্টমি নামক একটি চিকিৎসা-ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়। এ-ব্যবস্থায় রোগী প্রতিদিন একটি ব্যাগ পরিধান করেন । যাহোক, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুস্থ মহিলা তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন এবং পরিবার ও সমাজের লোকজনের সাথে সহজভাবে চলাফেরা করতে পারেন।

ক্যাথেটার ব্যবহার করে ফিস্টুলার চিকিৎসা

ফিস্টুলা খুব প্রাথমিক অবস্থায় চিহ্নিত করা গেলে ক্যাথেটার ব্যবহার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। এক্ষেত্রে ফলি ক্যাথেটার ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এতে একটি বেলুনের সাহায্যে একে জায়গামতো ধরে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।

ফলি ক্যাথেটার মূত্রথলি থেকে প্রস্রাব বয়ে নিয়ে তা সঠিক পথে বের করে দেয়। এই পদ্ধতিতে মূত্রথলির দেওয়ালের প্রসারণের সুযোগ থাকে, যার ফলে প্রসারিত মুত্রথলি ফিস্টুলার ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তগুলোকে একসাথে এনে জোড়া লাগার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।ছোট আকারের ফিস্টুলার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর।

কিছুকিছু ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত বা দীর্ঘায়িত প্রসবের ফলে ফিস্টুলার পাশাপাশি পায়ে পরিবাহিত স্নায়ুর ক্ষতি হওয়ার কারণে রোগীর হাঁটতে অসুবিধা হয় । এসব ক্ষেত্রে ফিস্টুলার চিকিৎসার পর রোগীকে ফিজিওথেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

ফিস্টুলার চিকিৎসার সমস্যা

জ্ঞান ও তথ্যের অপ্রতুলতা কোনো মহিলার ফিস্টুলার চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। ফিস্টুলার যে বেশ ভালো চিকিৎসা-ব্যবস্থা রয়েছে তা বেশিরভাগ মহিলাই জানেন না। আবার অনেকসময় জানা থাকা সত্ত্বেও অনেক মহিলা লজ্জায় বা ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখে যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুনর্গঠনমূলক অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তা ফিস্টুলার চিকিৎসাকে আরো জটিল করে তোলে। এছাড়াও, অভিজ্ঞ শল্যচিকিৎসক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব এবং চিকিৎসা-ব্যয়ের দিকগুলোও ছোট করে দেখার মতো নয়।

যেসব দরিদ্র দেশে ফিস্টুলার হার অনেক বেশি সাধারণত সেসব দেশে ফিস্টুলার চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার করার মতো সুব্যবস্থা এবং সম্যক কারিগরি দক্ষতা ততটা সহজপ্রাপ্য নয়। তাছাড়া, অনেক মহিলার পক্ষেই এধরনের চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

কীভাবে প্রসবজনিত ফিস্টুলা প্রতিরোধ করা যায়

গর্ভাবস্থায় মায়ের পর্যাপ্ত সেবাযত্ন, সন্তান প্রসবের সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অবলম্বন, একাধিকবার সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিরতি সম্পর্কে জ্ঞান, নারীশিক্ষার উন্নয়ন এবং বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ফিস্টুলা প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।

ফিস্টুলার সাথে সম্পর্কযুক্ত শারীরিক এবং সামাজিক বিষয়গুলো সম্পর্কে স্থানীয় জনগণকে জানাতে হবে। ফিস্টুলা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টির একটি অন্যতম পন্থা হলো মহিলাদেরকে স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা এবং গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের সময় সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দান করা এবং তা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা।

বাধাগ্রস্ত ও দীর্ঘায়িত প্রসব এবং ফিস্টুলার ঝুঁকি এড়ানোর জন্য প্রত্যেক মহিলার জীবনের শুরুতেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, যেমন মহিলাদের মানসম্মত পুষ্টি এবং পুষ্টি সংক্রান্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি মেয়ে শিশুর পুষ্টির চাহিদা ঠিকমতো পূরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতার গুরুত্ব এবং বাধাগ্রস্ত প্রসবের সম্ভাবনা দেখা দিলে সিজারিয়ান অপারেশনের সুফল সম্পর্কে প্রত্যেক মহিলা ও স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীকে সচেতন করে তোলা দরকার।

দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য, অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে কাজ করে থাকে এমন সংস্থাগুলো ফিস্টুলা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে ফিস্টুলা প্রতিরোধ একটি প্রধান ধাপ।

লেখক
ফৌজিয়া আখতার হুদা আইসিডিডিআর,বি

Tag: ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী ফিস্টুলা কী