স্মৃতিশক্তি হারালে মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন?

মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন?”সব ভুলে যাই তাও ভুলিনা বাংলা মায়ের বোল” গানটা অনেকেই শুনেছেন।কথা সত্যি! অচেতন অবস্থায় বাঙ্গালী ভুলভাল কথা বললেও সেটা কিন্তু বাংলাতেই বলে।

আবার কোন কারণে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে বাঙ্গালি পাগল হয়ে গেলেও কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা ভুলে যায় না।পাগল গালি দিনে বাংলাতেই দেয়।শুধু বাঙ্গালি নয় এই ঘটনা পৃথিবীর সকল মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।তাহলে আসুন জানাযাক আসল বৈজ্ঞানিক কারণ,স্মৃতিশক্তি হারালে মানুষ সব ভুলে যায়, কিন্তু মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন?

আপনি আরো পড়তে পারেন… এন্টিভেনম কি? সাপের বিষের প্রতিষেধক ….. মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি করুন ১০ উপায়ে|তৈরি করুন স্মার্ট ব্রেইন|

আলোচ্য বিষয়টি দুটি পৃথক উপাদানে বিভক্ত তাই বর্ণনার সুবিধার্থে দুইটি আলাদা ভাগে আলোচনা করলাম।

প্রথমে জানাযাক স্মৃতি বা মেমরি সম্পর্কে

স্মৃতি বা মেমোরি কি?

প্রাণির মস্তিষ্কের সিন্যাপস গুলোতে কোনো তথ্য সংরক্ষণ করা এবং পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে সেই তথ্য পুনরুদ্ধার করার পুরো প্রক্রিয়া কে স্মৃতি বা মেমোরি বলা হয়।আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন স্মৃতি মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্থানের সিন্যাপস এ টুকরো টুকরোভাবে জমা থাকে।আমরা যখন কোন স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করি, তখন ঐ টুকরো টুকরো অংশগুলো জোড়া লেগে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র আমাদের মনের জানালায় ভেসে উঠে।

স্মৃতি কিভাবে তৈরি হয়?

মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন স্নায়ু কোষ বা নিউরন আছে। এসব নিউরন পরস্পরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সিন্যাপস নামক জাংশনের মাধ্যমে। সিন্যাপস এ নিউরোট্রান্সমিটার নামক তরল থাকে এই তরলের সঞ্চালনের মাধ্যমে স্নায়ু উদ্দিপনা পরিবাহিত হয়।

সিন্যাপস এর একপাশে থাকে গ্রাহক নিউরন অন্যপাশে থাকে প্রেরক নিউরন। গ্রাহক নিউরন বা স্নায়ুকোষেরা যখন প্রতিবেশী স্নায়ু থেকে একই নিউরোট্রান্সমিটার অসংখ্য পরিমাণে পায়, তখন সে প্রেরক স্নায়ুর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে।

এই যোগাযোগের ফলে তৈরি হয় নতুন সিন্যাপস। কোন ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটলে ঐ ঘটনার স্মৃতি এই নতুন সিন্যাপস এ জমা থাকে। অর্থাৎ মস্তিষ্কে নতুন স্মৃতি তৈরি হওয়ার সময় বিভিন্ন স্নায়ুকোষের মধ্যে নতুন নতুন সিন্যাপ্স তৈরি হয়।

খুব সহজ কথায় বলতে গেলে বলা যায় স্মৃতিগুলো আমাদের মস্তিষ্কের নিউরণের সংযোগ বিন্দু বা সিন্যাপস গুলোতে অণুবীক্ষণিক রাসায়নিক পরিবর্তন হিসেবে সংরক্ষিত হয় ।

একাধিক নিউরনের মধ্যে গঠিত সিন্যাপ্সের সক্রিয়তা দীর্ঘস্থায়ী হলে স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী হয় আবার সিন্যাপস এর সক্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী হলে স্মৃতিও ক্ষণস্থায়ী হয়।দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিকে বলে Long-term Memory ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিকে বলে Short-term Memory।স্মৃতিশক্তি হারালে মানুষ সব ভুলে যায়, কিন্তু মাতৃভাষা ভুলে যায় না

স্মৃতিশক্তি হারালে মানুষ সব ভুলে যায়, কিন্তু মাতৃভাষা কেনো ভুলে না কেন?
সিন্যাপস

স্মৃতি বা মেমোরির প্রকারভেদ

স্মৃতির প্রধান দুটি প্রকার

অবচেতন স্মৃতি(Subconscious memory)

অবচেতন স্মৃতি আমাদের অবচেতন মনে তৈরি হয় । এই স্মৃতি মানুষ মনে রাখার চেষ্টা করে না বা মনে রাখতে হবে এরকম চিন্তা করে না। নিজের প্রয়োজনে বারবার একই কাজ করার ফলে মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া সিন্যাপস গুলো বেশ মজবুত হয়।

তবে এই মেমোরিগুলো খুব ধীরগতিতে আমাদের মস্তিষ্কে পৌছায় কিন্তু এই স্মৃতি এতই মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী যে এটা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।মানুষ অবচেতন মনে বা সজাগ না থেকেও এই ধরণের স্মৃতি ব্যবহার করে অনেক কাজ নিখুঁতভাবে করে ফেলতে পারে।

যেমন – শিশু পরিবারের কাছ থেকে অবচেতন মনে মাতৃভাষা শেখার পর তা যোগাযোগের প্রয়োজনে বারবার ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী, মজবুত স্মৃতিতে পরিণত করে।পরবর্তীতে শিশুটি বড় হলে কথা বলার সময় আর চিন্তা করতে হয়না এমন কি ঘুমের মধ্যে বা অচেতন অবস্থায় কথা বলার সময় মাতৃভাষায় কথা বলে ।

মাতৃভাষা ভুলে যায় না।জুতার ফিতে বাঁধা শেখা, সাইকেল বা গাড়ি চালানো শেখা ইত্যাদি এই স্মৃতি গুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেলে আমারা চোখ বন্ধ করেও এই কাজ গুলো করতে পারি।এক কথায় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বেশিরভাগ অভ্যাস ই অবচেতন স্মৃতি বা (সহজাত স্মৃতি)।

চেতন স্মৃতি বা (Conscious memory)

আমরা যে স্মৃতি গুলো জোর করে মনে রাখতে চাই তাকে চেতন স্মৃতি বলে। এই স্মৃতি খুব দ্রুত সংরক্ষিত হয় আবার খুব দ্রুত হারিয়েও যায়।
তবে অনেকবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে Conscious memory ও Unconscious memory তে রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন- কাল পরীক্ষা আজ সারারাত খুব পড়াশুনা করে সব পড়া মুখস্ত করলেন পরীক্ষা বেশ ভালো দিলেন।
কিন্তু ১সপ্তাহ পর আপনার আর কিছুই মনে নেই।

এবার আসাযাক মাতৃভাষার বিষয়ে।

মাতৃভাষা কি?

শিশু জন্মের পর তার মা, বাবা এবং পরিবারের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে ভাষা শেখে তাকে মাতৃভাষা বলে।
মাতৃভাষা শিক্ষা একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য।মাতৃভাষা মুখস্থ করে শিখতে হয় না।অবচেতনভাবে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্সে স্থায়ী স্মৃতি হিসেবে জমা হয়।শিশু মাতৃভাষা ভুলে যায় না।

মাতৃভাষা মস্তিষ্কের কোথায় জমা থাকে?

প্রায় ৯০% মানুষে মাতৃভাষা জমা থাকে মস্তিষ্কের বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ারে। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের বাম পার্শ্বে Broca’s Area নামক স্থানে ভাষা উৎপাদন হয় এবং এর কার্যকরীতায় ভাষা উচ্চারিত হয়।
টেম্পোরাল লোবের বাম পার্শ্বে অবস্থিত Wernicke’s area ভাষার উন্নতি সাধণ করে এবং অন্যের মুখ থেকে উচ্চারিত ভাষা বুঝতে সাহায্য করে।

মাতৃভাষা মস্তিষ্কের কোথায় জমা থাকে?
Broca’s Area

মানুষ মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন?

জন্মের পর থেকে শিশু তার মা,বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য লোকদের মুখ থেকে মাতৃভাষা শুনে মনে রাখে।সহজাত বৈশিষ্টের কারণে এই মাতৃভাষা অবচেতন স্মৃতি হিসেবে জমা হতে থাকে। অবচেতন স্মৃতি দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত হয়।
এই স্মৃতি মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল কর্টেক্স এর বাম পাশে স্থায়ী স্মৃতি ভান্ডাড়ে জমা হয়।

দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি মজবুতভাবে সংরক্ষিত হলে তা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শিশু প্রথম ভাষা শেখার সময় মাতৃভাষা বারবার ব্যবহার করে ফলে এই স্মৃতি বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আরও মজবুত হয়। এ কারণে কোন মানুষকেই মাতৃভাষা মুখস্থ করতে হয়না।

শিশু কথা বলতে শেখে ১-২ বছরের মধ্যে। জীবনের ১ম তিন বছরে মস্তিষ্কে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১মিলিয়ন সিন্যাপস তৈরি হয়।
এসময় মস্তিষ্ক খুব দ্রুত স্মৃতি জমা করে।শিশু এ সময় খুব কম বিষয় মুখস্ত করে তাই মস্তিষ্কের স্মৃতি ধারণ ক্ষমতাও বেশি থাকে।
৬ বছরের মধ্যে মস্তিষ্কের ৯০% গঠন পূর্ণ হয়।

এই ৬ বছর পর মস্তিষ্কের রূপান্তর প্রায় সম্পন্ন হওয়ার কারণে শিশু নতুন বিষয় মুখস্থ করতে থাকে বা নতুন পড়াশুনা শিখতে থাকে এগুলো অর্জিত স্মৃতি হিসেবে জমা হয়।

অর্জিত স্মৃতি দ্রুত মস্তিষ্কে জমা হয় কিন্তু খুব দ্রুত ডিলিট হয়ে যায়। চিন্তা করুন একটা বইয়ের ১০০০ শব্দ আপনি এক সপ্তাহে মুখস্ত করে ফেলেন কিন্তু শিশুর মা,বাবা দাদা, ইত্যাদি ছোট ছোট শব্দ শিখতে প্রায় ১বছর লেগে যায়।এই শব্দগুলো শিশু জোর করে মুখস্ত করে না এটা সহজাতভাবে মস্তিষ্কে জমা হয় অবচেতন বা সহজাত স্মৃতি হিসেবে।

তাই মানুষ মাতৃভাষা ভুলে যায় না।শুধু ফ্রন্টাল কর্টেক্স নয় মাতৃভাষা এক সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে অল্প অল্প করে জমা হতে থাকে।
ভেবেচিন্তে কথা বলার সময় এসব ক্ষুদ্র স্মৃতি নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে একত্রিত হয় এবং Broca’s Area তে প্রেরিত হয়। এসময় আমরা ধীর গতিতে কথা বলি।

কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে দ্রুত কথা বলার সময় যাতে অল্প সময়ে ভাষা ডেলিভারি দেয়া যায় সেজন্যে ঐ ক্ষুদ্র স্মৃতি ইউনিট এককভাবে ভাষা ব্যবহারে কাজ করে। এতে সময় অনেক কম ব্যয় হয়।কিন্তু এসময় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

কিছুটা কম্পিউটারের ক্যাশ মেমোরির মত।তাহলে এখন আমরা বুঝতে পারলাম মাতৃভাষার প্রধান স্টোরেজ ফ্রন্টাল কর্টেক্স এর বামপার্শ্ব এবং সহায়ক স্টোরেজ পুরো মস্তিষ্ক।এদের পরিচালক হিসেবে কাজ করে Broca’s Area ও Wernicke’s area।মস্তিষ্কে বড় ধরণের কোন আঘাত লেগে অথবা স্ট্রোকের কারণে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোন অংশ অকেজো হয়ে গেলে দেহের নির্দিষ্ট অঙ্গ বিকল হয়ে যায় কিন্তু মাতৃভাষা ভুলে যায় না।

এর কারণ হলো,মাতৃভাষার প্রধান স্টোরেজ অকেজো হলেও সহায়ক স্টোরেজ সহজাত বৈশিষ্টের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে নেয়।আবার তীব্র মেন্টাল ডিপ্রেশন বা আঘাত জনিত কারণে মানুষের স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেলেও মাতৃভাষা ভুলে যায় না।এর কারণ হলো, অর্জিত স্মৃতি মস্তিষ্কের সমস্যার কারণে ডিলিট হলেও সহজাত বা অবচেতন স্মৃতি ডিলিট হয় না।

একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই, ধরুন কম্পিউটারের মেমোরি ফুল হওয়ার কারণে কম্পিউটার চালু হচ্ছে না এসময় কম্পিউটার সেভ মুপে চালু করলে শুধু অত্যাবশ্যকীয় মেমোরি সচল রেখে বাঁকি মেমোরি বন্ধ করে কম্পিউটার চালু হবে। একই রকম ভাবে মস্তিষ্কের স্মৃতি নষ্ট হলেও অবচেতন বা সহজাত স্মৃতি যা বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় তা কখনো নষ্ট হয় না।

যেহেতু মাতৃভাষা সহজাত স্মৃতি সেহেতু মাতৃভাষা ভুলে যায় না।তবে মারাত্মকভাবে মস্তিষ্কের ৮০% এর বেশি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা Broca’s Area নষ্ট হলে কথা বলার ক্ষমতা ধ্বংস হয় ফলে সেই সময় মাতৃভাষাতেও কথা বলতে পারবেন না।

মানুষ মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন?
মাতৃভাষা শুনে মনে রাখে

Manush mattri vasha vulena keno?

mattri bhasa bhule na keno?মাতৃভাষা ভুলে যায় না, mother tongue ki? mattri vasa kothay joma thake? মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন মাতৃভাষা ভুলে যায় না কেন

Please Click On Just One Add To Help Us

মহাশয়, জ্ঞান বিতরণের মত মহৎ কাজে অংশ নিন।ওয়েবসাইট টি পরিচালনার খরচ হিসেবে আপনি কিছু অনুদান দিতে পারেন, স্পন্সর করতে পারেন, এড দিতে পারেন, নিজে না পারলে চ্যারিটি ফান্ডের বা দাতাদের জানাতে পারেন। অনুদান পাঠাতে পারেন এই নম্বরে ০১৭২৩১৬৫৪০৪ বিকাশ,নগদ,রকেট।

এই ওয়েবসাইট আমার নিজের খরচায় চালাই। এড থেকে ডোমেইন খরচই উঠেনা। আমি একা প্রচুর সময় দেই। শিক্ষক হিসেবে আমার জ্ঞান দানের ইচ্ছা থেকেই এই প্রচেষ্টা। আপনি লিখতে পারেন এই ব্লগে। এগিয়ে নিন বাংলায় ভালো কিছু শেখার প্রচেষ্টা।