হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি কী? সোনার চেয়ে দামি ছত্রাক!!

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি কী? সোনার চেয়ে দামি ছত্রাক!!

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিডা জড়ি শব্দটি আমাদের কাছে অপরিচিত একটি নাম কিন্তু যারা এই শব্দটার সাথে পরিচিত তারা জানে এটি কতটা আশ্চর্য একটি নাম। এটি একটি মূল্যবান ভেষজ। এর বাজার মূল্য আকাশছোঁয়া। আপনি বড়লোক হতে চাইলে এই জিনিষের চাষ করতে পারেন। যৌনশক্তি বর্ধক হিসেবে এর ব্যবহার পৃথিবীর সর্বত্র। এই কিডা জরি সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারান। আসুন আজ যেনে নেই এই আশ্চর্য পদার্থের বিস্তারিত আলোচনা….

আপনি আরোও পড়তে পারেন…… মহুয়া। মহুয়া ফুল ও ফল এর ব্যবহার।

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কী?

হিমালয়ান ভায়াগ্রা, এই  মূল্যবান ভেষজটিকে ভারতে ‘কিডা জড়ি ’ বলা হয় এবং হিমালয়ের সোনা  নামেও পরিচিত। কিড়া জড়ি শব্দটি দুটি শব্দ কিড়া+জড়ি নিয়ে গঠিত। কিড়া শব্দটির অর্থ- কীট এবং জড়ি শব্দের অর্থ জড়িবুটি।

Ophiocordycipitaceae পরিবারের ঘোস্ট মথের দেহে এটা তৈরি হয় বলে একে কিড়া জড়ি বা caterpillar fungus বলে। ভারতের উত্তরাখণ্ডের অনেক এলাকায় এই ছত্রাক কিডা জরি (Keeda Jadi) বলে পরিচিত। অনেক অঞ্চলে এটা ইয়ারগুম্বাও নামে পরিচিত। চিনে এই ছত্রাক হিমালয়ান গোল্ড নামে পরিচিত। তবে এটি চীনা দের ভাষায় ইয়ার্তসা গুনবু নামে বেশি পরিচিত। চীনা ভাষায় এর ‘ডংচং-জিয়াকাও’ নামটা বেশ যুক্তিসঙ্গত। ডংচং অর্থ ‘উইন্টার ওয়ার্ম’ এবং জিয়াকাও মানে ‘সামার গ্রাস।’

হিমালয়ান ভায়াগ্রা এর বৈজ্ঞানিক নাম

Ophiocordyceps sinensis এর আর একটি বৈজ্ঞানিক নাম Cordyceps sinensis. 

হিমালয়ান ভায়াগ্রা কোথায় পাওয়া যায়?

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি এই বিরল মাশরুম গুলি খুব দুর্গম পাহাড়ের খাজে হয়। খাড়া ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে 12 ঘন্টারও বেশি সময় ধরে 25 কিলোমিটার পেরিয়ে এদের খোঁজ করতে হয়। এটি প্রধানত ভারতীয় হিমালয় এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের কিংহাই-তিব্বতীয় মালভূমিতে এবং 3000-5000 মিটার উচ্চতায় পাওয়া যায়। প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার লম্বা হিমালয় জুড়ে অবস্থিত নেপাল, ভুটান, তিব্বত ও চীনের বিভিন্ন তৃণাচ্ছাদিত মালভূমিতে এদের খোজ পাওয়া যায়। পশ্চিম হিমালয়ে সংরক্ষিত নন্দাদেবীসহ অন্যান্য বায়োস্ফেয়ারেও এদের দেখা পাওয়া যায় তবে যেখানে উৎপাদন কম।

হিমালয়ান ভায়াগ্রা কোথায় পাওয়া যায়?

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া-জড়ির ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিপার্শ্বের অনেক দেশ এটা উৎপাদন করার চেষ্টা করেছে যার অগ্রভাগে রয়েছে চীন। এখন ল্যাবরেটরির বয়ামে তৈরি হচ্ছে এই মাশরুম, যার গুণাগুণ চলনসই, তবে Ophiocordyceps sinensis বন্য প্রজাতির মতো কিড়া-জড়ি উৎপন্ন করা এখনো সম্ভব হয়নি।

কৃত্রিম চাষে ব্যবহার করা হয় কর্ডিসেপস্ মিলিটারিস (Cordyceps militaris) প্রজাতি। চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডে গবেষণাগারে এদের চাষ হয়, এমন কি ঘরোয়া পর্যায়েও। এই চাষে তাপমাত্রা ও বায়ুর আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতে উৎপাদন-কক্ষ সম্পূর্ণভাবে ব্যাক্টেরিয়ামুক্ত রাখতে হয়, সবকিছু স্টেরিলাইজ করতে হয়, এমন কি বোতলের ছিপি পর্যন্ত। এই উৎপাদনে সময় লাগে ৮০-৯০ দিন।

হিমালয়ান ভায়াগ্রার বর্ণনা

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি এক ধরনের মাশরুম। এটি বাদামী রঙের হয়। এটি ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা  যার একটি অংশ পোকা, আরেকটি অংশ মাশরুম। বোঁটাসহ আধাপাকা কাঁচা মরিচ শুকিয়ে গেলে যেমন দেখায় এটি দেখতে অনেকটা তেমন মরিচের মত। ইংরেজিতে এর নাম ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস।

হিমালয়ান ভায়াগ্রার বর্ণনা

হিমালয়ান ভায়াগ্রা কিভাবে তৈরি হয়?

প্রথমে, কর্ডিসেপস্ (Cordiseps) নামক ছত্রাকের রেণু এক বিঘৎ মাটির নিচে একজাতীয় মথের (Ghost moth) শূককীটকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত শূককীট মাটির নিচে থেকে উপরের দিকে উঠতে থাকে কিন্তু ভূমির ওপরে মাথা তোলার আগেই ছত্রাক-রেণু এদের মেরে ফেলে। বছরখানেক এভাবে থাকার পর এই কীটের মাথার দিকে বেড়ে ওঠে ছত্রাক। তৃণভূমির ভেতরে ব্রাউন কালারের এই ছত্রাক অন্যান্য তৃণের সঙ্গে রঙে রঙে মিশে থাকে। খুব দক্ষ না হলে এদের খুঁজে বের করা সম্ভব নয়।

হিমালয়ান ভায়াগ্রা কিভাবে তৈরি হয়?

কিড়া-জড়ি তৈরি হতে একবছর সময় লাগে আর মথের জীবনচক্র পূর্ণ হতে লাগে ৩-৪ বছর। এ সময়টাতে মথের শূককীট গাছের শেকড়ের রস খায় এবং ৬-৭ বার খোলস পাল্টায়। ৪ নম্বর খোলস পাল্টানোর পর একে ছত্রাক-রেণু আক্রমণ করে, আগে পরে নয়।

কিরা-জড়ি কখন সংগ্রহ করা হয়?

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি সংগ্রহের আদর্শ সময়, মে জুন জুলাই, এই তিন মাস। এ সময়ে সংগ্রহকারীরা পর্বতের ঢালে, সমতল মালভূমির তৃণাচ্ছাদিত অঞ্চলে তাঁবু গাড়ে, সঙ্গে নিয়ে যায় খাবার-দাবার ও মাশরুম তোলার কিছু হাতিয়ার।

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি ছত্রাকের দাম

চিনে এই ছত্রাকের চাহিদা সবথেকে বেশি। সেখানে বহুমূল্য এই ছত্রাক। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চীনে এই ছত্রাকের দাম কেজি প্রতি ১৩ লাখ  থেকে বেড়ে ২০ লাখ টাকা  হয়েছে। ভারতে এর মূল্য প্রতি কিলো ৩ থেকে ৫ লাখ রুপি হলেও বিদেশি বাজারে প্রায় ৪৫ হাজার ডলার অর্থাৎ সোনার চেয়ে বেশি।

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারি কিংবা নেতাদের উপহার হিসাবে দেওয়া হত বলেও জানা গেছে। চিন এই ভেষজ সংগ্রহের জন্য অরুণাচল প্রদেশে বেশ কয়েকটি জায়গায় অনুপ্রবেশ করেছে। ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধের পিছনে থাকা বিরল হিমালয় ভেষজ। বিশ্ববাজারে এর মূল্য সোনার চেয়েও বেশি কারণ এর থেকে তৈরি হয় নানারকম অমূল্য ঔষধ।

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি ছত্রাকের গুনাগুন

রাখালরা লক্ষ্য করেছে, চারণক্ষেত্র থেকে গবাদি পশুরা এসব মাশরুম খেয়ে ফেলে। এতে পশুর রোগবালাই থাকে না, মোটাতাজা হয়। এই জ্ঞান থেকে তারা এর ব্যবহার শিখতে শুরু করে। ফুসফুস ও কিডনির রোগ, ক্যান্সার, ডায়েবেটিস, টিউমার, টনিক, এন্টি এজিং, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করা, শুক্র বৃদ্ধি, লিবিডো বাড়ানো, ইত্যাদি বহুবিধ কারণে বিগত দু’দশক ধরে বিশ্ববাজারে হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ির চাহিদা বেড়ে গেছে দারুণভাবে।

  • হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি ছত্রাকের দেহে কর্ডিসেপিন নামক একটি জৈব সক্রিয় অণু থাকে যা অ্যাফ্রোডিসিয়াক বা যৌন উত্তেজক। এই কারণে এই ভেষজটির প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
  • বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে একদিন এই যৌগ একটি কার্যকর অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টি-ক্যান্সার চিকিত্সায় কাজে লাগবে।
  • এর ঔষধি গুরুত্ব ছাড়াও, এটি একটি প্রমাণিত পোকামাকড় ঘাতক। মাশরুমের স্পোর পোকামাকড়কে সংক্রামিত করে, তাদের মৃত্যু ঘটায়।
  • কিডনি রোগ থেকে পুরুষত্বহীনতা পর্যন্ত সমস্ত কিছু নিরাময়ের জন্য হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি ভেষজটির ব্যবহার করা হয়।
  • হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি স্পোর্টস মেডিসিনে খুব ভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। ধারণা করা হয় এটি খেলয়ারদের শারিরীক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ১৯৯৩ সালে বেইজিং ন্যাশন্যাল গেমস্-এ ৩টি চীনা মেয়ে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল, তাদের হারবাল ডায়েটের প্রধান উপকরণ ছিল কিড়া-জড়ি বা হিমালয়ান ভায়াগ্রা।

হিমালয়ান ভায়াগ্রা বা কিড়া জড়ি খাওয়ার নিয়ম

কিড়া-জড়ির কোনো সঠিক ডোজ এ যাবৎ নির্ধারিত হয়নি। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। সাধারণত একে গুঁড়ো করে দুধ, মধু বা পানির সঙ্গে সেবন করা হয়, তবে একটি বিষয় অভিজ্ঞতা থেকে প্রতীয়মান হয়েছে, শুধু মাশরুম বা শুধু শূককীট আলাদাভাবে খেলে তেমন ফল হয় না, দুটো একসঙ্গে মিশ্রিত করে খেতে হয়।