চিকুনগুনিয়া রোগ কী?চিকুনগুনিয়া লক্ষণ ও প্রতিরোধ!

চিকুনগুনিয়া রোগ কী?চিকুনগুনিয়া লক্ষণ ও প্রতিরোধ!

চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস মশার দ্বারা একজনের কাছ থেকে অন্যজনে এই রোগ ছড়ায়। এর লক্ষণ কিছুটা ডেঙ্গু জ্বরের মতো হওয়ায় অনেক চিকিৎসকই একে ডেঙ্গু ভেবে চিকিৎসা দেন।

চিকুনগুনিয়া রোগ কী?চিকুনগুনিয়া লক্ষণ ও প্রতিরোধ!

কোন মশা চিকুনগুনিয়া ছরায়?

বাংলাদেশে এ রোগ সাধারণ জনগণের কাছে খুবই অপরিচিত। তবে, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ঢাকার সুত্রাপুর, ধানমণ্ডি, মতিঝিল এবং মহাখালি এলাকায় ৬০০ লোকের ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে।

এডিস মশা
এডিস মশা

এই পরিসংখ্যান অনুসারে ৩৩ শতাংশ মানুষের চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশা দেহে চিকুনগুনিয়া রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটি প্রমাণ করে যে, চিকুনগুনিয়া রোগের জীবাণু তাদের শরীরে ঢুকেছিলো এবং বাংলাদেশে এ রোগের জীবাণুর উপস্থিতি রয়েছে।

আপনি আরো পড়তে পারেন … ডেঙ্গু জ্বর কী? ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার,প্রতিরোধ! …. কালাজ্বর কী? কালাজ্বর এর লক্ষণ ও প্রতিরোধ! ….. ম্যালেরিয়া জ্বর কী? ম্যালেরিয়া জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিরোধ।

বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ

বাংলাদেশে এ-রোগের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০০৮ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলায়। এই সময় পবা উপজেলার বেশ কিছু মানুষ জ্বর এবং মেরুদণ্ডের তীব্র ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। অন্যান্য রোগ থেকে একটু আলাদা মনে হওয়া এবং অধিকসংখ্যক রোগীর আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়ায় আইইডিসিআর থেকে একদল গবেষক সেখানে যান এবং সর্বপ্রথম একে চিকুনগুনিয়া বলে শনাক্ত করেন।

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস

এটি একটি আলফা ভাইরাস এবং RNA ভাইরাস, যাতে E, নামের একটি এনভেলপ প্রোটিন পাওয়া গেছে। এই প্রোটিন এডিস মশার পেটের কোষে তাদের আটকে থাকতে সহায়তা করে।

চিকুনগুনিয়া রোগের ব্যাপ্তি

চিকুনগুনিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা গেলেও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এটি বেশি দেখা যায়। এছাড়াও, বিভিন্ন দেশে মাঝেমাঝে এ রোগের প্রকোপ দেখা যায়। চিকুনগুনিয়া প্রথম ১৯৫২ সালে তানজানিয়াতে দেখা যায়। এরপর আফ্রিকা, এশিয়া, এমনকি বর্তমানে

উত্তর আমেরিকাতেও এ রোগ দেখা যায়। এশিয়া মহাদেশের ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, হংকং এবং মালয়েশিয়ায় এ রোগ দেখা যায়।

চিকুনগুনিয়া রোগ কিভাবে ছরায়

চিকুনগুনিয়া কিভাবে ছড়ায়

এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে চিকুনগুনিয়া ছড়ায় মশার কামড়ের মাধ্যমে। এডিস মশা রোগাক্রান্ত মানুষকে কামড়িয়ে অন্য মানুষকে কামড়ালে সে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।

এডিস প্রজাতির মেয়ে মশারা সাধারণত এই ভাইরাস ছড়ায়। এখানে বলে রাখা ভালো যে,এডিস মশা সাধারণত স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। বাসা-বাড়ির আশপাশে ছোট কৌটা বা পাত্রে যদি স্বচ্ছ পানি থাকে, তবে এ মশা সেখানে বংশ বিস্তার করে।

আরো বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, বাসার পাশে নারিকেলের খোলা, ফুলের টব বা ফুলদানি, পানি রাখার পাত্র, এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্র বা তাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে জমে থাকা পানি, টায়ার, প্লাস্টিকে জমে থাকা পানিতে এরা ডিম পাড়ে।

এই মশারা মূলত দিনের বেলায় কামড়ায়, তবে সকাল ও বিকেলে এরা বেশি সক্রিয় থাকে। বর্ষাকালে এ রোগ ছড়ানোর সুযোগটা সবচাইতে বেশি কারণ এসময় মশার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয়।

মানুষ Chikungunya ভাইরাসের বাহক। তবে, কখনও কখনও বানর, ইঁদুরজাতীয় প্রাণী এবং পাখিও এ রোগ বহন করে থাকে।

চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ

চিকুনগুনিয়া জ্বর হলে নিচে বর্ণিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।

চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ

জ্বর

কোনো মানুষ চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হলে তার ঘন ঘন জ্বর হয়। দেহের তাপমাত্রা ১০১° থেকে ১০৩° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। তবে, এ রোগে জ্বরের সাথে রোগীরা তাদের সমস্ত শরীর ও মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। জ্বর টানা ১২ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।

Rash বা ফুসকুড়ি

শিশুদের ক্ষেত্রে অনেকসময় গায়ে ছোট-ছোট হালকা গোলাপী দানা (rash) দেখা দেয় (শিশুরা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে সম্ভবত তাদের শরীরে ব্যথার জন্য)।

ব্যথা

সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয়। তাই, জ্বরের সাথে রোগী শরীর ও পিঠব্যথা অনুভব করে। সাথে হাড়ের জোড়ার ব্যথার কথাও বলে।

শিশুদের লক্ষণ

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ থেকে শিশুদের ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়াকে আলাদা করা যায় না, কারণ শিশুদের শরীরে ব্যথার কথা বোঝার অন্য কোনো উপায় নেই। তবে, এসময় ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। তাদেরকে প্রতিটি লক্ষণ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মা কিংবা অভিভাবকের কাছ থেকে রোগের পূর্ণ ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। গতানুগতিক চিকিৎসা দিলে বা ইতিহাস না-শুনে চিকিৎসা দিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস কিভাবে সংক্রমন করে?

এ-রোগে ভাইরাস লিম্ফয়েড টিস্যু, লিভার, হাড়ের জোড়াগুলোতে প্রথমে বাসা বাধে এবং সংখ্যায় বাড়তে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের মতো এ রোগে প্লাটিলেটের কোনো সম্পর্ক নেই।

লক্ষণীয় যে, এ-রোগে আক্রান্ত রোগীরা প্রায় সবাই কিছু অভিযোগ করে থাকে,

যেমন:
গায়ে দানা এবং অনেক দিন ধরে জ্বর (দু’সপ্তাহ) থাকে।

ডেঙ্গুর সাথে চিকুনগুনিয়ার মিল ও পার্থক্য

রোগের লক্ষণডেঙ্গুচিকুনগুনিয়া
জ্বরথাকবেথাকবে
শরীরে দানার মত ফুসকুড়ি১-৪ দিনের মধ্যে দেখা যাবে।৫-৭ দিনের মধ্যে দেখা যাবে।
চোখে ব্যথাথাকবে নাথাকবে
গিটে ব্যথাথাকবেথাকবে না,খুবই কম ক্ষেত্রে থাকবে।
দানার মত ফুসকুড়ি থেকে রক্তপাতখুবই কম ক্ষেত্রে থাকবে।৫-৭ দিনের মধ্যে থাকবে

চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ল্যাবোরেটরিতে অনেকভাবে শনাক্ত করা যায়। তবে, নিম্নোক্ত কয়েকটি পদ্ধতি বেশি প্রচলিত

১. জ্বর শুরুর প্রথম পাঁচদিনের মধ্যে রক্ত নিয়ে ল্যাব-এ IgM-এর উপস্থিতি ELISA method-এর মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। এটি প্রাথমিকভাবে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শরীরে আছে কি না তা নিশ্চিত করে

২. আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য RT-PCR করা যায়, যার মাধ্যমে আরো নিশ্চিতভাবে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।

চিকুনগুনিয়া জ্বরের চিকিৎসা

Chikungunya একটি ভাইরাসজনিত রোগ। তাই, এর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে, এক্ষেত্রে জ্বর ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি।

চিকুনগুনিয়া রোগের ঔষধ

জ্বরের ক্ষেত্রে সাধারণত প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। কোনো প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিভাইরাস ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।

ব্যথা কমানোর জন্য কোনো ওষুধ দেওয়ার আগে এতে বিদ্যমান উপাদান সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা জরুরি, কারণ ওষুধ সঠিক না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এসপিরিন বা স্টেরয়েডজাতীয় নয় এমন ওষুধ সাধারণত এ রোগে ব্যবহার করা হয় ব্যথা ব্যবস্থাপনার জন্য।

চিকুনগুনিয়া রোগের ব্যথা কমানোর উপায়

শরীরে ব্যথা কমানোর জন্য খুব হালকা ব্যায়াম করলে ভালো উপকার পাওয়া যেতে পারে। তবে, ভারী ব্যায়াম উল্টো বিপদ ডেকে আনতে পারে।

পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে আস্তে-আস্তে এ রোগ সেরে যায়। একটি ভালো বিষয় হলো এ রোগে মৃত্যু হওয়ার ঝুঁকি খুবই কম। তবে, অসুখ সেরে উঠতে অনেক সময় লাগে। বড়দের ক্ষেত্রে ১ থেকে ২.৫ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে, ছোটদের ক্ষেত্রে এ রোগ ৫ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সেরে যায়।

চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধ

এ রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই। তাই, প্রতিরোধই সবচাইতে ভালো। এজন্য আমরা:

  • বাসার আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে
  • রাখতে পারি।
  • স্বচ্ছ পানি জমতে পারে এমন কিছু থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে পারি, যেমন ফুলের টবের অতিরিক্ত পানি, ফুলদানির পানি, তাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের পানি, বাসার পাশে পড়ে থাকা কৌটা, ডাবের খোল, ইত্যাদি।
  • যাদের বাসায় গাড়ি আছে তাদের অব্যবহৃত টায়ার সরিয়ে রাখা দরকার, কারণ এতে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে এবং মশা সেখানে ডিম পাড়ে।
  • গ্রামে বা মফস্বলে ঝোপঝাড় পরিস্কার করে রাখতে পারি।
  • দিনের বেলা বা রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে পারি।

লেখক
চৌধুরী মোঃ গালিব, আইসিডিডিআর,বি

Please Click on Just one Add to help us

মহাশয়, জ্ঞান বিতরণের মত মহৎ কাজে অংশ নিন।ওয়েবসাইট টি পরিচালনার খরচ হিসেবে আপনি কিছু অনুদান দিতে পারেন, স্পন্সর করতে পারেন, এড দিতে পারেন, নিজে না পারলে চ্যারিটি ফান্ডের বা দাতাদের জানাতে পারেন। অনুদান পাঠাতে পারেন এই নম্বরে ০১৭২৩১৬৫৪০৪ বিকাশ,নগদ,রকেট।

এই ওয়েবসাইট আমার নিজের খরচায় চালাই। এড থেকে ডোমেইন খরচই উঠেনা। আমি একা প্রচুর সময় দেই। শিক্ষক হিসেবে আমার জ্ঞান দানের ইচ্ছা থেকেই এই প্রচেষ্টা।