ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ থাকার উপায়!

ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ থাকার উপায়!

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ আমাদের সবার অতি পরিচিত। শরীরে ইনসুলিন-নামক অতি জরুরী একটি হরমোন যথেষ্টভাবে উৎপন্ন না হলে বা তা উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও শরীরের কোষগুলো এই ইনসুলিন এর প্রতি সংবেদনশীল না হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলা হয়ে থাকে।

এ রোগ ছোঁয়াচে নয়, তবে এটি একটি ক্রনিক রোগ, যা মূলত বংশগতভাবে বিস্তার লাভ করে এবং অনেক পরিবারেই বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে এ রোগ দেখা যায়।দিনদিন ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে।

ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশন-এর মতে ২০১০ সালে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ২৮ কোটি ৫০ লাখ, যা পূর্ণবয়স্ক জনগোষ্ঠির শতকরা ৬.৭%। ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৪৩ কোটি ৮০ লাখে গিয়ে ঠেকতে পারে। বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর প্রায় ৭০% নিম্ন ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোর জনগণ। বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি ক্রমশই অবনতির দিকে যাচ্ছে।

ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ থাকার উপায়!

ডায়াবেটিস বিভিন্ন জটিল রোগের অগ্রদূত। এর সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো এ রোগ কখনো সারে না, বরং শরীরে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন জটিল রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে এ-কথা সত্যি যে, কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা ঠিকমতো মেনে চললে একজন ডায়াবেটিক রোগী ভালো থাকতে পারেন এবং স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন।

আপনি আরও পরতে পারেন …. খাবার কম খাওয়ার উপকারিতা! কম খান সুস্থ থাকুন!

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ থাকার উপায়গুলো নিচে আলোচনা করা হলো।

ডায়াবেটিক রোগীর খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা

১. ডায়াবেটিক রোগীর জন্য উপযোগী খাবার খাবেন।

চিনিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করে থাকেন এমন একজন ডায়েটিশিয়ান-এর কাছে এ-বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারেন।

একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির জন্য ২৪ ঘণ্টায় ক্যালরি গ্রহণের আদর্শ পরিমাণ নিম্নরূপ:

পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির কাজের ধরণক্যালরি গ্রহণের আদর্শ পরিমাণ
হালকা ধরনের কাজ করেন২৫ কিলোক্যালরি/কেজি।
মাঝারি ধরনের কাজ করেন৩০ কিলোক্যালরি/কেজি।
ভারী কাজ করেন৩৫ কিলোক্যালরি/কেজি।
ক্যালরির এই পরিমাণ স্বাভাবিক ওজনের প্রাপ্তবয়স্কদের (BMI ১৮ থেকে ২৫) জন্য
প্রযোজ্য।
BMI ১৮-র কম হলে খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং ২৫-এর বেশি হলে কমাতে হবে।

ডায়াবেটিক রোগীর খাবারে আনুপাতিকভাবে ৫০-৬০% শর্করা (কার্বোহাইড্রেট), ১৫-২০% আমিষ (প্রোটিন) এবং ৩০-৩৫% চর্বিজাতীয় (ফ্যাট) উপাদান থাকা উচিত।ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত বারডেম হাসপাতালে বহুল ব্যবহৃত ডায়াবেটিস বইয়ের ২৭-৩৬ পৃষ্ঠায় একজন ডায়াবেটিক রোগীর জন্য উপযোগী খাবারের বর্ণনা দেওয়া আছে।

২. প্রতিদিন পাঁচবার খাবার খাবেন

সকালের নাস্তা, দিনের মাঝামাঝি সময়ে হালকা নাস্তা, দুপুরের খাবার, বিকেলে হালকা নাস্তা এবং রাতের খাবার।

৩. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করুন

ডায়াবেটিস এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ওজন জীবন বিপন্ন করতে পারে তাই ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন কঠোরভাবে।

৪. ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন।

ডায়াবেটিস রোগী ধূমপান করলে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। এছারাও বিভিন্ন জটিল শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।তাই ধূমপান বর্জন করুন।

ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন

৫. দৈনিক ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন

  • সাঁতার কাটা, যোগব্যায়াম বা সাইকেল চালানোর মতো হালকা ব্যায়াম করুন।
  • প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটুন।
  • এমনভাবে যোগব্যায়াম করতে চেষ্টা করুন যেন ঘাম ঝরে। এরপর কিছু সময় বিশ্রাম নিন। যোগব্যায়ামের সাহায্যে আপনার শরীর ও মনের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে চেষ্টা করুন।
  • আশপাশের কোনো ব্যায়ামাগার, কোনো সংঘ বা ক্রীড়াচক্রের সাথে জড়িত হতে চেষ্টা করুন। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতি খেলায় অংশগ্রহণ করুন ।

ডায়াবেটিক রোগীর গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ

HbA1c-র আদর্শ মাত্রা ৬.৫% ধরা হয়ে থাকে। একজন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে HbA1c পরীক্ষাটি করান এবং তাঁর কাছ থেকে আপনার জন্য প্রযোজ্য লক্ষ্যমাত্রা জেনে নিন। HbA1c যেন নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করতে না-পারে সেভাবে চলতে চেষ্টা করুন। যথার্থ খাদ্য গ্রহণ অথবা একটি ওষুধ সেবনের মাধ্যমে HbA1c আয়ত্তে রাখতে পারলে খুবই ভালো। ছয়মাস পরপর HbA1c পরীক্ষা করুন।

ডায়াবেটিক রোগীর উচ্চ রক্তচাপ

যাঁদের উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস বা কিডনির রোগ নেই তাঁরা বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ মাপুন । যাঁরা উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ সেবন করছেন বা কিডনির রোগে ভুগছেন তাঁরা প্রতি ৪-৬ মাস পরপর রক্তচাপ পরীক্ষা করাতে ভুলবেন না। একজন ডায়াবেটিক রোগীর স্বাভাবিক রক্তচাপ ১৩০/৮০ mmHg ধরা যেতে পারে।

রক্তে লিপিড

ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে লিপিড-এর আদর্শ মাত্রা

পরীক্ষার নামআদর্শ মান
কোলেস্টেরল৩.৮৮ mmol/L
ট্রাইগ্লিসারাইড১.৭ mmol/L

ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা কমানোর উপায়

পায়ের যত্ন নিন

প্রতিবছর অন্তত একবার অভিজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারা পা পরীক্ষা করুন। সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন এবং পায়ের যত্ন নিন। চোখ পরীক্ষা করুন—ডায়াবেটিস রোগীদের বছরে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করানো উচিত। চোখে কোনো সমস্যা দেখা দিলে আরো ঘনঘন চোখ পরীক্ষা করা এবং উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন ।

কিডনি পরীক্ষা করুন

প্রস্রাবে মাইক্রো অ্যালবুমিন আছে কি না তা পরীক্ষা করুন। নিয়মিতভাবে সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির কার্যকারিতা পরিমাপ করুন।

স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করুন

স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে নিয়মিত স্বল্পমাত্রার অ্যাসপিরিন সেবন করুন।

টাইপ ১ ডায়াবেটিসে ইনসুলিন গ্রহণের নিয়ম

একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাহায্যে ডায়াবেটিসের মাত্রা অনুযায়ী আপনার জন্য প্রয়োজনীয় ইনসুলিনের ডোজ নির্ধারণ করিয়ে নিন। হাইপার ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া-র মতো জরুরী অবস্থায় রোগী নিজে তাঁর ইনসুলিনের ডোজ কিছুটা বাড়িয়ে বা কমিয়ে নিতে পারেন এবং পরে অবস্থার উন্নতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।

সাধারণত খালিপেটে গ্লুকোজের মাত্রা ১৪ mmol/L বা তার বেশি থাকলে এবং HbA1c-র মাত্রা ৭% বা তার বেশি থাকলে রোগীকে ইনসুলিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দেখা দিলে বা ডায়াবেটিস রোগীর শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হলে সাধারণত ইনসুলিনের সাহায্যে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা হয়ে থাকে ।

ডায়াবেটিস রোগীর গ্লুকোজ-এর আদর্শ মাত্রা

খাবার সময়গ্লুকজের মাত্রা
খাওয়ার পর<১০ mmol/L থাকা উচিত
খাওয়ার আগে৪-৬ mmol/L থাকা উচিত

ডায়াবেটিস রোগীর টিকা

সময়মত ফ্লু, নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য রোগের টিকা গ্রহণ করে এসব রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করুন।

ডায়াবেটিসপ্রসূত রোগ এবং জটিলতা

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস যেসব রোগের পথকে সুগম করে তোলে এবং সমস্যা সৃষ্টি করে, সেগুলো হলো স্ট্রোক, পায়ের গ্যাংগ্রিন, হৃদরোগ, চোখের ছানি, মূত্রনালীর বারবার সংক্রমণ, ফোঁড়া, মাড়ির প্রদাহ, কিডনির নিষ্ক্রিয়তা, শারীরিক অক্ষমতা, যক্ষ্মা, ডায়রিয়ার প্রবণতা, গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের পরে বা আগে সন্তান প্রসব অথবা মৃতসন্তান প্রসবের সম্ভাবনা, ইত্যাদি।

একজন ডায়াবেটিক রোগীর এসব বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত।

হাইপার এবং হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণসমূহ

শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে বা কমে গেলে তাকে যথাক্রমে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়ে থাকে। একজন ডায়াবেটিক রোগী যেকোনো সময় হাইপার বা হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন; এই দু’টি অবস্থাই রোগীর জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই, এর বিভিন্ন লক্ষণ,

  • যেমন শরীর খুব কাঁপতে শুরু-করা,
  • অতিরিক্ত ঘাম-হওয়া,
  • তীব্র ক্লান্তি অনুভব-করা,
  • শরীরে ব্যথা অনুভব-করা,
  • খিঁচুনি-হওয়া,
  • দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে ওঠা,
  • বিভ্রান্ত বোধ-করা,
  • মাথা ঘোরা,
  • বুক ধড়ফড়-করা প্রভৃতি সম্পর্কে রোগীকে সচেতন থাকতে হবে।

হাইপারগ্লাইসেমিয়ার চেয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে রোগীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই, এসব ক্ষেত্রে রোগীর উচিত দ্রুত সামান্য একটু চিনি বা যেকোনো মিষ্টি খাবার খাওয়া, যাতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে থাকলে তা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায়। পরে একটু সুস্থ বোধ করলে গ্লুকোজ পরিমাপ করে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।

উপসংহার

মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে এ রোগকে জয় করা কোনো ব্যাপারই না। ডায়াবেটিস রোগকে রাস্তার সিগনাল বাতির সাথে তুলনা করা হয়েছে। সিগনাল বাতি যেমন রাস্তার যানবাহনের চলাচলকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখে, আমাদের জীবনেও তেমনি শৃঙ্খলা বজায় রেখে ডায়াবেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি।

লেখক
এ.এইচ.এম. মফিজউদ্দীন
আইসিডিডিআর,বি

Tag: ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ