চিপ কি? বিশ্বব্যাপী চিপ শর্টেজের কারণ#
শিরোনাম পড়ে বুঝি ভেবেই বসেছেন, ছোটো বাচ্চাদের রাস্তাঘাটে যে-কোনো দোকান থেকে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে কিনে খাওয়া পটেটো চিপসের চিপের কথা বলছি। না, পটেটো চিপস আর এই চিপ এক না। অত্যুষ্ণ মরুভূমির বালিতে জলবিহীন মানুষ হাঁটতে শুরু করলে কিছুক্ষণের মধ্যে দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করে। অথচ, সেই মরুভূমির বালিতে থাকা সিলিকনকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন বাক্স উদ্ভাবন করে সময় বাঁচাতে লেগে পড়েছে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের মানুষ।
প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে যে-কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির প্রধান মাধ্যম কম্পিউটার চিপ, যা আমরা মুঠোফোন থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, এমনকি রকেটেও ব্যবহৃত হতে দেখছি। বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহৃত এই চিপের শর্টেজ চলছে। চলুন, কম্পিউটার চিপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাসহ জেনে নেয়া যাক যে, কেন চিপ-সংকট প্রযুক্তিবিশ্বকে থমকে দিল।
আপনি আরও পড়তে পারেন …… পেগাসেস স্পাইওয়্যার এক ভয়ংকর স্পাইওয়্যারের কাহিনী! ….. বিটকয়েন কী? কী কাজে ব্যবহৃত হয়?লাখপতি হওয়ার ধান্দা#
চিপ জিনিসটা কী:
আপনি নিশ্চয়ই এখন মুঠোফোন বা কম্পিউটার বা ল্যাপটপ, যা-ই বলুন, সেটা দিয়ে আর্টিকেলের লেখাগুলো পড়ছেন। কীভাবে পড়তে পারছেন, ভেবে দেখেছেন? হ্যাঁ, ধারণা অনেকটা সঠিক। মরুভূমির বালিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা সিলিকন-বেইজড চিপ আপনার ফোনের বা কম্পিউটারের ভেতরে রয়েছে। আপনারা মাঝে মাঝে ‘প্রসেসর’ বলতে যেই শব্দটা শুনে থাকেন, সেটিও মূলত এই চিপের সাথেই সংযুক্ত একটি অংশবিশেষ।
বর্তমানে, বেশিরভাগ মোবাইল ফোন এবং যে-কোনো কম্পিউটারে শুধু চিপ(Chip) থাকে না। থাকে এসওসি(SoC), অর্থাৎ System-on-Chip যেটাকে বলে। এর মানে হলো, শুধু চিপ না। এর সাথে Processor(CPU), GPU, Modem সবই সংযুক্ত বা embedded থাকে। সিলিকন-বেইজড এই চিপে থাকে লক্ষ লক্ষ ট্রানজিস্টর। এটা মূলত SoC-এর উপর নির্ভর করে। SoC যতটা শক্তিশালী হবে, ট্রানজিস্টরের সংখ্যাও ততটাই যে বেশি হবে, ব্যাপারটা এমন না।
তাই, ট্রানজিস্টরের সংখ্যাটি বিলিয়নের ঘর অবধিও পৌঁছতে পারে। যেমন, Apple A12 Bionic চিপে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা ৬.৯ বিলিয়ন প্রায়। আবার, কোনো-কোনো চিপে এই সংখ্যাটা আরও কম হতে পারে, কিন্তু সেই চিপটা Apple A12 Bionic-এর চেয়েও অধিক শক্তিশালী হতে পারে। এই ট্রানজিস্টরের গেইটগুলোকে আকার-আকৃতিতে গাণিতিকভাবে nanometre(nm) দ্বারা হিসেব করা হয়। আজকাল এই nm বা nanometer সংখ্যাটা অনেক কমে আসছে।
এখন তো স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে 5nm, 6nm বা 7nm Chip ও ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সংখ্যাটা যতটা কমের দিকে আসছে, স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ততটা দ্রুত কাজ করতে পারছে এবং কর্মদক্ষতা(Power Efficiency) ততটাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসাথে, ডিভাইসের ভেতরে ব্যবহৃত সবধরনের যন্ত্রাংশ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং ব্যাটারি কম খরচা হচ্ছে। ডিভাইসে SoC বসানোর জায়গায়ও কম লাগছে।
চিপ কোথায় উৎপাদন হয়:
Chip উৎপাদনের ইতিহাস জানতে গেলে অর্ধশতবর্ষের চেয়ে একটু বেশি পেছনের দিকে যেতে হয়। ১৯৫৯ সালে সিলিকন-বেইজড আইসি (IC), অর্থাৎ Integrated Circuit উদ্ভাবনের পর ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেই একই দু-জন প্রকৌশলী জ্যাক কিলবি এবং রবার্ট নয়েস কম্পিউটারের ভেতর ব্যবহারযোগ্য সর্বপ্রথম সিলিকন-বেইজড মাইক্রোচিপ উদ্ভাবন করেছিলেন। Chip তৈরির প্রথম নির্মাতাদেশ যুক্তরাষ্ট্র হলেও, সেখানে এখন আর অতটা Chip তৈরি করা হয় না।
বর্তমানে বিশ্বের ৯০% চিপ দক্ষিণ এশিয়ার তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তৈরি করা হয় যার মধ্যে, শুধু তাইওয়ানেরই বিশ্বব্যাপী Chip উৎপাদনে মার্কেট শেয়ার ৫৫%। ফলে, এই দুটো দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে প্রযুক্তিনির্ভর গোটা পৃথিবীর। তাইওয়ানের বিখ্যাত TSMC কোম্পানি চিপ তৈরির ক্ষেত্রে বর্তমানে সর্বসেরা। তবে, দক্ষিণ কোরিয়ার টেক-জায়ান্ট Samsung-ও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।
পূর্বে, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘Intel’ এবং আরও কিছু কোম্পানি ইলেকট্রনিক Chip তৈরি করা শুরু করলেও Chip তৈরিতে খরচ এবং বিক্রয়মূল্য অত্যধিক হওয়ায়, TSMC-এর মত বড়ো কোম্পানির কাছ থেকে সস্তায় Chip তৈরি করে নিচ্ছে তারা। বিশ্বে চীন প্রযুক্তিগতভাবে সর্বাধিক উন্নত হলেও সেখানে আবহাওয়াগত ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে ও সিলিকনের বা সেমি-কন্ডাকটর সেক্টরে কোনো কাজ হয় না বলে, চীনে Chip তৈরি করা হয় না বা তৈরি করার কারখানা তেমন নেই।
চীনেও কিছু Chip তৈরি হয়, কিন্তু সেই প্রযুক্তি বলা যায়, বহুযুগ পিছিয়ে রয়েছে। ভারত উপমহাদেশেও যান্ত্রিক দক্ষতা, কারখানা তৈরিতে বিনিয়োগ সমস্যা এবং কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে সেমি-কন্ডাকটর সেক্টরের বা Chip তৈরির কোনো কাজ করা হয় না।
বিশ্বব্যাপী চিপ শর্টেজের কারণ#
কোভিড-১৯’এর প্রাদুর্ভাবে নিরানন্দ বিশ্বের মানুষের কাজকর্ম বন্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষের ঘরোয়াপনার প্রভাবে পুরো বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ইলেকট্রনিক চিপের সংকট দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, Chip শর্টেজের বিষয়টা পুরোপুরি সত্য হলেও, কিছুটা দুর্নীতিও এক্ষেত্রে রয়েছে বটে। বড়ো বড়ো অটোমোবাইল কোম্পানি, ইলেকট্রনিক-ডিভাইস উৎপাদনকারী কোম্পানি এবং হাই-টেক কোম্পানিগুলো Chip শর্টেজের অজুহাতে মোবাইল-ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপের মত ইলেকট্রনিক পণ্যসামগ্রীর দাম অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়িয়েই চলেছে।
মূলত, ২০১৯ সালের পর থেকে স্মার্টফোন, কম্পিউটার/ল্যাপটপ এবং স্বয়ংক্রিয় গাড়ির দাম প্রচুর বেড়েছে। কারণ, এদের ভেতরে ব্যবহৃত চিপের দাম আকাশচুম্বী হতে বাকি। তাইওয়ানে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিগত ৫৬ বছরের মধ্যে সর্বাধিক ভয়াবহ খরা দেখা দেওয়ায় বিশুদ্ধ পানির প্রচণ্ড সংকট দেখা দেয়। আর, Chip তৈরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে একেবারে বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন। সেটার ক্ষেত্রেই খরার জন্য বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দেওয়ায় Chip তৈরির কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
সরকার থেকে তাইওয়ানে TSMC কোম্পানিকে নিয়মবদ্ধ করে দেওয়া হয় যে, তারা আজ অবধি যতটা পানি ব্যবহার করত Chip উৎপাদনে, তার চেয়ে ২০% পানি কম নিতে হবে TSMC-কে। যার জন্য চিপ উৎপাদনও কমে যাবে! এছাড়া, জাপানের “Renesas Electronics” কোম্পানি যারা গাড়ির জন্য মূলত Chip তৈরি করত, তাদের কারখানায় আগুন লেগে গিয়েছিল।
আবার, আমেরিকাতে Samsung-এর একটা কারখানায় অসাবধানবশত লেগে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের মত ভয়াবহ ঘটনার ফলে Chip উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং বড়ো বড়ো অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো Chip কিনতে না পারায় থতমত খেয়ে বসে। ২০২০ সালের ৮ই মার্চে GIZMOCHINA, ZDNet, SAMMobile-সহ আরও জনপ্রিয় কিছু অনলাইন প্রযুক্তি-খবরাখবরের পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়াতেও Samsung-এর Chip তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
তবে, এই ঘটনাটি কোভিড-১৯ চলাকালীন হলেও Samsung-এর চিপ উৎপাদনে তেমন কোনো বাধাদায়ক হয়নি।TSMC, Samsung, Renesas-এর মত নামিদামি Chip উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আগে যতটা Chip উৎপাদন করতে পারত, এখনকার দিনে তা আর পারছে না। এছাড়াও, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মত দেশগুলোর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়া এবং লকডাউনের জন্য সেখানে কারখানা-বন্ধসহ নানা কারণে Chip উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
Chip -নির্মাতা প্রতিষ্ঠান TSMC বলেছে, ২০২৩ সাল শুরুর আগে আগে এসব সমস্যা আর থাকবে না, যদি আর কোনো দুর্যোগ না আসে। কিন্তু, অন্তত ২০২২ সালের শেষ অবধি এই সমস্যা সমূলে উৎপাটন করার কোনো উপক্রম নেই। আবার, ইদানীং ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও কয়েকবছর থেকে প্রচুর বিনিয়োগ করা হচ্ছে। বিগত কয়েকবছর ধরে প্রচুর পরিমাণে ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং করা হচ্ছে, যার জন্য গ্রাফিক্স কার্ডের প্রয়োজন, কম্পিউটারের প্রয়োজন।
এসবের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ চিপের প্রয়োজন, যার জন্য এগুলোর চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এজন্য আগেকার মত পর্যাপ্ত পরিমাণে Chip সরবরাহ করার মত ক্যাপাসিটি নিয়ে পুরোনো কারখানাগুলো আর চাহিদা সম্পন্ন করতে পারছে না।
5G নেটওয়ার্ক এর উপর চিপ শর্টেজের প্রভাব:
এখন 5G নেটওয়ার্কের যুগ চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ইতোমধ্যে 5G নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। ভারত উপমহাদেশে, অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশেও শীঘ্রই 5G আসছে। এসবের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করা হচ্ছে 5G নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম লাগাতে এবং নানারকম 5G ডিভাইস স্থাপনের জন্য।
সেই ডিভাইসগুলো চলে অবশ্যই ইলেকট্রনিক চিপ দিয়ে। তাই, এতটাই চাহিদা বেড়ে গিয়েছে 5G-এর জন্য চিপের যে, সেই চাহিদা পূরণ করতে গিয়েও চিপের অনেক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। Google, Facebook, Amazon, Zoom-এর মত বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো পূর্বেই উপলব্ধি করে ফেলেছিল যে, আগামী দিনে জনমানুষ অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে বেশি সময় কাটাবে, অর্থাৎ সংখ্যাগুরু তারা তাদের যাবতীয় কাজ অনলাইনে এবং ভার্চুয়ালি করবে।
ঘরে বসে অনলাইনে তাদের কাজ অনেক বেড়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের চাহিদা বাড়বে এবং সমগ্রবিশ্বই অনলাইন-কেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। তার জন্য, কোম্পানিগুলোর ডেটা-সেন্টারগুলো উন্নত করা, সার্ভারের ধারণক্ষমতা আরও বাড়ানো, যন্ত্র-সরঞ্জাম আরও বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
কারণ, আগামীর যুগটা হয়ত ক্লাউড-কম্পিউটিংয়ের যুগ হবে। এই ভেবে কোম্পানিগুলো তাদের সার্ভার বাড়াতে থাকল, বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন ডেটা এবং সার্ভার-সেন্টার স্থাপন করতে শুরু করল। আর, সেই স্থাপন করতে গিয়ে তাদেরও মাইক্রোচিপ বা প্রসেসর বা এসওসি(SoC)-এর ব্যাপক প্রয়োজন পড়ল।
যখন বড়ো বড়ো এই প্রতিষ্ঠানগুলো Samsung এবং TSMC-এর মত নামিদামি চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চিপের জন্য চাহিদা করল, তখন সেই কোম্পানিগুলোর চাহিদা আগে মিটিয়ে তারপর-না TSMC বা Samsung ছোটো ছোটো কোম্পানিগুলোর কাছে Chip সরবরাহ করবে! তো, বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা মেটাতে গিয়ে Chip উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ Chip শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ফলস্বরূপ, আমরা, সাধারণ মানুষরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপে চিপের অভাব এতটা অনুভব করছি। খুব বেশিদিন আগের কথা না, মাত্র বছরখানেক পূর্বেও আমরা ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্মার্টফোন কিনতে গেলে তার মধ্যে যা যা ব্যবহারী ফিচার এবং সুযোগ পেতাম, এখন আর তা মোটেও পাচ্ছি না। এখন ২০ হাজার টাকার ফোনেও এতটা ফিচার পাওয়া এবং সুযোগ-সুবিধা অনুভব করা যাচ্ছে না। এরকম ছোট্টো-ছোট্টো সুযোগ-সুবিধাগুলো নিয়ে বোঝাপড়া হচ্ছে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের দাম কম রাখার জন্য, কস্ট কার্টেইলমেন্টের(Cost Curtailment) জন্য।
তাই আমাদের মনে হচ্ছে, আগের তুলনায় এখন স্মার্টফোনের দাম অত্যধিক বেশি। সত্যিই তাই! বর্তমানে বিশ্ববাজারে স্মার্টফোনের দাম বলা যায়, আকাশচুম্বী। ধারণামতে, ২০১৯ সালের পর থেকে একই দামে কেনা স্মার্টফোনের বিল্ড কোয়ালিটি, ক্যামেরা কোয়ালিটি, সফটওয়্যার অপটিমাইজেশন থেকে আরম্ভ করে জরুরি অনেকক্ষেত্রেই পূর্বের তুলনায় নিম্নতা দেখা দিচ্ছে। এর কারণ, বিশ্বজুড়ে Chip শর্টেজ বা চিপের সংকট।
বিশ্বজুড়ে উৎপাদন স্বল্পতায় চিপের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। যার ফলে, স্মার্টফোনসহ ল্যাপটপ/কম্পিউটার, স্বয়ংক্রিয় গাড়ির দাম গ্রাহকের ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে গিয়েছে। ইলেকট্রনিক এসকল ডিভাইসের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বা কম্পোনেন্টের দামও বেড়ে গিয়েছে। আগে যেমন পাওয়া যেত, তেমন এখন স্মার্টফোনে 3.5mm হেডফোন জ্যাক (Headphone Jack), সেকেন্ডারি নইজ ক্যানসেলেশন মাইক (Secondary Noise-Cancellation Mic), লো-বাজেটের ফোনে ভিডিয়োগ্রাফির ক্ষেত্রে অতিপ্রয়োজনীয় এবং বিশেষ একটি ফিচার EIS (Electronic Image Stabilization)-এর আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
উদ্দেশ্য, কস্ট কার্টেইলমেন্ট(Cost Curtailment) অথবা, দাম কম রাখা। এর জন্য, আমরা আগের তুলনায় বেশি অর্থ খরচ করেও খারাপ মানের স্মার্টফোন কিনছি। এছাড়াও, স্বয়ংক্রিয় গাড়ির উৎপাদনও অনেকাংশেই কমে গিয়েছে। হিসেবে দেখতে গেলে, যেখানে একটি স্মার্টফোন তৈরি করার জন্য ৫টি চিপের প্রয়োজন হয়, সেখানে একটি স্বয়ংক্রিয়-ইলেকট্রনিক গাড়ি নির্মাণ করতে কমছে কম ১৫টি চিপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু, স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রিতে এখনও অনেককিছুই ভালো আছে, সব মোটামুটি ঠিকঠাক চলছে। গ্রাফিক্স কার্ডের বাজারে যে-কোনো পণ্য ২ গুণ, ৩ গুণ, এমনকি ৪ গুণ বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
এতটা প্রাদুর্ভাব স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রিতে পড়েনি। গ্রাফিক্স কার্ডের দাম বেড়ে যাওয়ার কিছুটা কারণ, গ্রাফিক্স কার্ডের ক্ষেত্রে কালোবাজারি। কম্পিউটারের সাথে সম্পর্কিত যতকিসিমের ডিভাইস রয়েছে, তার দাম একবার ঊর্ধ্বমুখী হলে সেটা আর নিচে নামতে চায় না। বাংলাদেশ, ভারত তথা ভারত উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর অসাধুপথে পদচারণায় এসব ঘটছে।
এই অসাধু ব্যবসায়ীরা ডিভাইসগুলোকে গুদামজাত করে রেখে কৃত্রিমভাবে ডিভাইসগুলোর দাম বাড়িয়ে রাখে। এভাবে স্টক ধরে রেখে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা কালোবাজারি করে অধিক অর্থ আয় এবং ব্যবসায় লাভ করছে। এরকমটাই হচ্ছে গ্রাফিক্স কার্ডের সঙ্গে।
তারা জানে যে, বিশ্বব্যাপী চলমান চিপ শর্টেজ সমস্যা অতিসহজে মিটবে না, তাই চিপ শর্টেজ সমস্যা মিটে গেলেও দীর্ঘদিন ধরে তারা গ্রাফিক্স কার্ড এবং কম্পিউটারের বিভিন্ন ডিভাইসগুলোর কম্পোনেন্টগুলোর ঊর্ধ্বে যাওয়া দাম আর কমতে দেবে না। ধারণা করা হচ্ছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের এই কালোবাজারি অন্তত গ্রাফিক্সের কার্ডের ক্ষেত্রে আগামী ২-৩ বছর চলবে।
চিপ শর্টেজ সমস্যা নির্মূল কবে হবে:
বিশ্ববিখ্যাত তাইওয়ানের সেমি-কন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান TSMC জানিয়েছে, ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে এই সমস্যা অনেকটা মিটে যেতে পারে এবং ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে চিপ শর্টেজ সমস্যা ও এর প্রাদুর্ভাব বিশ্বব্যাপী আর থাকবে না, যদি আবার কোভিড-১৯’এর তৃতীয় ওয়েভ না হানা দেয় কিংবা কোনো দুর্ঘটনা বা দৈবদুর্যোগ এসে না দাঁড়ায়। তাই, বলা যায়, আগামীতে এই সমস্যার সমাধান হবে এবং সবকিছু আগের ন্যায় স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
তবুও ভয় যে, নির্মূল হয়ে যাওয়ার কয়েকমাস পরে আবারও কি এরকম সংকট দেখা দিতে পারে? তাই, প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বকে আবারও যেন এরকম সংকটাপন্ন হতে না হয়, এজন্য বড়ো বড়ো প্রযুক্তি-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে ডলার বিনিয়োগ করছে। চীন যে-কোনো সময় তাইওয়ান দখল করে নিতে পারে, আর যুক্তরাষ্ট্র সেটা কিছুতেই হতে দিতে পারবে না।
তার কারণ, বিশ্বের সর্বাধিক চিপ তাইওয়ানে উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ চেষ্টা করছে, চিপ উৎপাদনের ভরকেন্দ্রটা তাইওয়ান থেকে সরে নিয়ে তাদের দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আবার, কিছুদিন আগেই তাইওয়ানের TSMC সেমি-কন্ডাকটর কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা তৈরি এবং চিপ সরবরাহের উদ্দেশ্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বিনিয়োগ করেনি, আরও অনেক দেশেই বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু মুখ্যত যুক্তরাষ্ট্রে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে TSMC। এইসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে বিশাল একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার টেক-জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান Samsung আমেরিকাতে চিপ-নির্মাণ কারখানা স্থাপনের জন্য ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। কম্পিউটারজগতে চিপ-নির্মাণে বিখ্যাত এক নাম Intel। এই Intel কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে চিপ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। আগামীদিনে চিপ-সংকট না দেখা দেয় যাতে করে, তাই এসব বড়ো বড়ো কোম্পানি এত বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্রের বুকে। চিপ-সংকট নির্মূলে সবাই পর্যাপ্ত এবং যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
কিন্তু, শুধু পুঁজি বিনিয়োগ করলেই বিষয়টা শেষ নয়, এর সাথে প্রয়োজন অনেক সময়ের। একটা চিপ-নির্মাণ কারখানা তৈরি করতে গেলে কমপক্ষে ৩-৪ বছর এমনকি, ৫ বছর অবধিও সময় লেগে যেতে পারে। চীন প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেও চিপ-উৎপাদন কারখানা নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের আশেপাশে যেতে পারছে না। কারণ, সেখানে সিলিকনের কোনোপ্রকার কাজ হয় না এবং কিছু আবহাওয়াগত কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে।
আর আগেই বলে এসেছি যে, চীনেও কিছু পরিমাণ চিপ উৎপাদন করা হয়, কিন্তু তাদের প্রযুক্তি বলতে গেলে, সেকেলে। তবে, ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতে হয়ত চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের চিপ উৎপাদনের প্রতিযোগিতার সুবাদে সমগ্রবিশ্বে চিপের এই সংকট সমূলে উৎপাটন হতে পারে এবং কতটা দ্রুত তা হতে পারে, সেটা দেখার বাকি রইল। আর, স্মার্টফোনের জগতে স্মার্টফোনের দাম অন্তত ২০২২ সাল অবধি কমবে না। বরংচ, ২০২২ সালে দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
একইভাবে, গ্রাফিক্সের কার্ডের দাম অন্তত ২০২৪ সাল অবধি কমবে না, আরও বাড়বে। TSMC, Samsung, Intel-এর মত চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে আগামীতে চিপের দাম এরকমই বাড়িয়ে রাখবে। কারণ, তারা এবার চিপগুলো গুদামজাত শুরু করবে। আর, এটা করতে গেলে অতিরিক্ত যেই খরচটা হবে, সেটা নিশ্চয়ই আপনার, আমার মত সাধারণ গ্রাহকরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্ধের মত প্রদান করতে হবে। এরকম করতে করতে শেষমেশ কী হবে, তা বলার জুড়ি নেই কিন্তু, আগামী দিনে ইলেকট্রনিক চিপের দাম আরও বাড়বে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
Info source: wikipedia …. Britannica.com
এই লেখাটা লিখেছে একজন অবদানকারী।আপনিও লিখুন ভালকাজে অংশ গ্রহণ করুন।
লেখক পরিচিতি
Please Click on Just one Add to help us
মহাশয়, জ্ঞান বিতরণের মত মহৎ কাজে অংশ নিন।ওয়েবসাইট টি পরিচালনার খরচ হিসেবে আপনি কিছু অনুদান দিতে পারেন, স্পন্সর করতে পারেন, এড দিতে পারেন, নিজে না পারলে চ্যারিটি ফান্ডের বা দাতাদের জানাতে পারেন। অনুদান পাঠাতে পারেন এই নম্বরে ০১৭২৩১৬৫৪০৪ বিকাশ,নগদ,রকেট।এই ওয়েবসাইট আমার নিজের খরচায় চালাই। এড থেকে ডোমেইন খরচই উঠেনা। আমি একা প্রচুর সময় দেই। শিক্ষক হিসেবে আমার জ্ঞান দানের ইচ্ছা থেকেই এই প্রচেষ্টা।