ছাপাখানা আবিষ্কারের গল্প!জন গুটেনবার্গ#
আমরা এখন যে সব বই, মাসিকপত্র ও খবরের কাগজ পড়ি, তা’ সবই ছাপাখানাতে যন্ত্রের সাহায্যে ছাপা হয়ে থাকে—একথা তোমরা সবাই জান। কত রকমের রঙচঙে সুন্দর মলাটে বাঁধান বিচিত্র ছবিতে ভরা গল্পের বই, কবিতার বই, স্কুলের পড়ার বই, আরও নানা রকমের কত কি বই তোমরা বই’র দোকানে সাজান দেখতে পাও। এই সমস্তই এরূপ সুন্দর সাজে সজ্জিত হ’য়ে ছাপাখানা হাতে বেরিয়ে আসে।
এই ছাপাখানার জন্মকথা, বোধ করি, তোমাদের মধ্যে অনেকে জান না। মুদ্রণযন্ত্রের কখন কোথায় জন্ম হ’ল ও ধীরে ধীরে তা বেড়ে উঠে আজ কি করে এমন বিরাট আকার ধারণ করল সেই গল্প এখন তোমাদের বলব।
আপনি আরও পড়তে পারেন…….. প্যারাসুট কী? প্যারাসুট এর ইতিহাস,গঠন,কাজ# ……
এমন একসময় ছিল, যখন এসব ছাপাখানা ছিল না। তখনকার দিনে পুস্তকাদি সব হাতেই লেখা হত। মাইনে দিয়ে লোক রেখে বই লেখান হ’ত। ইউরোপে ধর্ম্মযাজকরাও অনেক সময় নিজের হাতে বই লিখতেন। আমাদের দেশেও পুস্তক, পুঁথি প্রভৃতি আগেকার দিনে হাতেই লেখা হ’ত। এখনও এরকম হাতেলেখা অনেক পুঁথি কোন কোন জায়গায় সযত্নে রক্ষিত আছে দেখা যায়।
তখনকার দিনে এক একখানি বই লেখা এত পরিশ্রম ও বায়সাধ্য ছিল ও তাতে সময়ও এত বেশি লাগত যে, বইয়ের দাম করতে হ’ত খুবই বেশি। আর এত দাম দিয়ে কিনে ক’জন লোকই বা বই পড়তে পারে! কাজেই তখনকার দিনে ধনশালীরাই বই কিনতে পারত। সাধারণ লোকের পক্ষে তা কিনে পড়া একরকম অসম্ভব ছিল, এই কারণে দেশের অধিকাংশ লোককে তখন বাধ্য হ’য়ে অজ্ঞ ও নিরক্ষর হয়ে থাকতে হ’ত।
এখনকার দিনে কত লক্ষ লক্ষ পুস্তক ছাপাখানা তাতে সহজে মুদ্রিত হয়ে আসছে, আর কত অসংখ্য লোক তা’ পড়ে’ জ্ঞান অর্জন করছে।পুস্তকাদির দাম এখন এত সুলভ হয়েছে যে, বলা যায় এই মুদ্রাযন্ত্র আজ বিদ্যামন্দিরের দুয়ার ধনী নির্ধন নির্ব্বিশেষে সকলেরই নিকট উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
বহুপূর্ব্বকালে চীনদেশেই সর্বপ্রথম কাঠের ওপর অক্ষর খোদাই করে পুস্তক মুদ্রিত করবার উপায় উদ্ভাবিত হয়, পরে কোরিয়াতেও কাঠের ও মাটির অক্ষর তৈরি করে’ তা’ সাজিয়ে নিয়ে পুস্তকাদি মুদ্রিত করা হ’ত।কিন্তু চীনদেশে কি কোরিয়াতে মুদ্রাঙ্কণ কার্য আর বেশি দূর অগ্রসর হ’তে পারেনি। বর্তমান কালের মুদ্রাযন্ত্রের উদ্ভাবন এসব দেশে হয়েছিল এ কথা ঠিক বলা যায় না।
যে অদ্ভুত প্রতিভাশালী পুরুষকে বর্তমানকালের মুদ্রাযন্ত্রের উদ্ভাবন- কর্তা বলা যায়, তাঁর নাম জন গুটেনবার্গ। গুটেনবার্গ জার্মানীর মেনঝ্ শহরে ১৪০০ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।খুব উন্নত ও শিক্ষিত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তিনি নিজেও খুব শিক্ষিত ও তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন।গুটেনবার্গ হীরা, জহরৎ ও মণিমুক্তা কেনাবেচার ব্যবসা করতেন।মূল্যবান পাথরকাটা কাজে তিনি একজন ওস্তাদ ছিলেন, ভাস্কর্য ও চিত্রবিদ্যাতেও তিনি একজন দক্ষ শিল্পী ব’লে তাঁর খ্যাতি খুব কম ছিল না।
কি করে’ তাঁর মাথায় মুদ্রাযন্ত্র উদ্ভাবনের খেয়ালটি প্রথম উদয় হয় তা বড়ই কৌতুহল উদ্দিপক। একদিন খাওয়া-দাওয়ার পরে তিনি আর তাঁর স্ত্রী তাঁর দোকানের পেছনের ঘরটিতে বসে বেশ আনন্দে গল্প- গুজব করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ গুটেনবার্গের দৃষ্টি পড়ল গিয়ে একখানি তাসের ওপর। সেই তাসখানি তাঁদের সেই ঘরের মেজের ওপর পড়ে ছিল। গুটেনবার্গ তাসখানি তুলে নিয়ে একদৃষ্টে ত দেখতে লাগলেন এবং তা’কে উল্টেপাল্টে নানাভাবে পরীক্ষা করতে লাগলেন।
কিছুতেই তাঁর দৃষ্টি আর অন্যদিকে যায় না। সব গল্পগুজব হঠাৎ বন্ধ হ’য়ে গেল। এই ব্যাপারে তাঁর স্ত্রী একান্ত বিস্মিত হ’য়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন – “ঐ তাসখানির ভিতর এমন কি অদ্ভুত জিনিষ রয়েছে যে, তুমি তা’ অমন করে দেখছ ? তুমি তা’ এমন একাগ্রচিত্তে দেখছ যে, কেউ দেখলে ভাববে,তুমি কোন সাধুপুরুষ কি দেবতার মূৰ্ত্তিই বুঝি বা দেখছ । ”
গুটেনবার্গ বলেন—“আমি ভাবছিলুম এ ছবিখানি কি করে করলে। “
গুটেনবার্গের স্ত্রী বলেন- “কেন অন্য দশটা ছবি যেমন করে আঁকা হয় এও তেমন করে আঁকা হয়েছে। প্রথম কতকগুলো রেখার সাহায্যে ছবিটি সুন্দর করে একে নিয়ে তার ওপর রঙ দেওয়া হ’য়েছে। এ আর এমন কি ।”গুটেনবার্গ বললেন—“দেখ তা নয়, এরূপ ছবি আঁকিবার তার চেয়ে ঢের সহজ ও সুন্দর উপায় আছে।
এই লাইনগুলো প্রথম একখানা কাষ্ঠ-ফলকের ওপর সুন্দর করে আঁকা হয় এবং পরে সে সব লাইনের চারদিককার কাঠ খুব নিপুণভাবে এমন করে কেটে নেওয়া হয় যে, এই চিহ্নিত রেখাগুলো বেশ উঁচু হয়ে থাকে। এইভাবে খোদিত মূর্তিটির ওপর ভাল করে’ কালি লাগিয়ে পিস্-বোর্ডের ওপর তার ছবি মুদ্রিত করে নেওয়া হয় । এনা ! এই হচ্ছে খুব সহজ উপায় । আলাদা আলাদা করে এক একখান। কার্ডে ছবি আকতে হলে ঢের পরিশ্রম ও সময়ের দরকার হয়। কিন্তু এই রকমের একখানি কাঠের ব্লক একবার তৈরি করে নিতে পারলে তা’ হ’তে বিনা কষ্টে যত খুসী ছবি কার্ডে ছেপে নেওয়া যায়।”
এই ঘটনার পরে গুটেনবার্গ খুব উৎসাহের সহিত এরূপ ব্লক নিৰ্ম্মাণ কার্য্যে প্রবৃত্ত হ’লেন, ও তিনি স্থিরসংকল্প করলেন যে, এই উপায়ে ছবি এবং পুস্তকাদি সব ছেপে নেবেন।গুটেনবার্গ প্রথমে এ কাজ শুরু করতে গিয়েই এক টুকরো কাঠ তাঁর দোকান থেকে নিয়ে এসে তার ওপর কয়েকটি রেখা এঁকে নিলেন ; এবং সেই চিহ্নিত রেখার চারদিককার কাঠ বেশ সাবধানে কেটে বের করে নিলেন। এইভাবে প্রথম তাঁর স্ত্রীর নামটি খোদাই করে নিলেন।
সেই নামটির ওপর কালি লাগিয়ে তা’ এক টুকরো কাগজের ওপর রেখে চাপ দিতেই ছাপা হয়ে গেল তা’র স্ত্রীর নামটি। তার স্ত্রী এই উপায়ে নিজের নামটি মুদ্রিত হ’তে দেখে অতি মাত্র চমকে উঠে আনন্দে বলে উঠলেন—“বাঃ বেশ চমৎকার হয়েছে ত! এ যেন ঠিক হাতের লেখার মত হয়েছে দেখছি!”
গুটেনবার্গের স্ত্রীর এইভাবে চমকে উঠবার কথা শুনে তোমরা বোধ হয় অনেকেই হাসবে। তোমরা বলবে – এতে আশ্চর্য হবার এমন কি আছে, একটি আলু কি কচি বেগুন চিরে নিয়ে একটি ছুরির সাহায্যে এ’ত যে কেউ করতে পারে। আর নামের ষ্ট্যাম্প তৈরি করাবার দোকানও ত ঢের ঢের রয়েছে। কিন্তু একটি কথা মনে রেখো যে পাঁচশ বছর আগে যখন গুটেনবার্গ এ কাধে হাত দিয়েছিলেন, তখন পথে ঘাটে নামের ষ্ট্যাম্প তৈরি করবার দোকানও ছিল না।
আর এভাবে কিছু খোদাই করতে খুব কম লোকই জানত। তখনকার দিনের লোকেরা এ রকমের কাজ দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত—যেমনটি করে তোমরা এখন চেয়ে থাক, যখন বাতাসের ভিতর দিয়ে, নীল আকাশের নীচ দিয়ে গুঞ্জন করতে করতে ছুটে চলে “এরোপ্লেন।”
এই প্রথম সাফল্যে অত্যন্ত উৎসাহিত হ’য়ে এবার এই খোদাই কাৰ্যো গুটেনবার্গ একাগ্রচিত্তে নিমগ্ন হলেন । তিনি নানা রকম কাঠ পরীক্ষা ক’রে এই কাজের জন্য বেছে নিলেন আপেল কাঠ। এই কাঠ বেশি নরমও নয় অথচ খুব কঠিনও নয়; তাই এই কাঠ তাঁর ব্লকনির্মাণ কার্যের জন্যে খুব উপযোগী হবে মনে করলেন।
এবার গুটেনবার্গ একখানা করি ফলকের ওপর এক সাধুপুরুষের মূর্ত্তি আঁকলেন ও তার নীচে তাঁ’র নামটিও লিখে নিলেন। সেই মূর্তিটি সুন্দররূপে কাষ্ঠ- ফলকের ওপর খোদাই করে নিয়ে যেই কালি লাগিয়ে একখানি কাগজের ওপর চাপলেন অমনি সাধুর মূর্ত্তি ও নামটি দিব্যি ছাপা হয়ে গেল।তিনি তখন তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন “দেখ এনা, এ ছবিটি তাসের ছবি হ’তে পরিষ্কার হয়েছে, তবু সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি। আরও ঘন কালিতে ছাপতে হবে, এ কালিটা বড় পাতলা, তাই ছাপতে গিয়ে এমন চুপসে যায়।”
এইবার তিনি ঘন কালি ও কয়েক রকমের সুন্দর রঙ, তৈরি করবার জন্য চেষ্টা আরম্ভ করলেন। অতি অল্পদিনের মধ্যেই তিনি অতি সুন্দর ঘন কাল কালি ও কয়েকটি সুন্দর সুন্দর রঙ, প্রস্তুত করে নিলেন। এখন তাঁর কালি ও রঙ, সম্বন্ধে আর কোন অসুবিধা রইল না। এবার গুটেনবার্গ এই নুতন কালি ও রঙ দিয়ে অনেক সাধু ও ধাম্মিক পুরুষের ছবি ছেপে নিলেন ও সে সব ছবি তাঁর দোকানে বেশ সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখলেন।
দোকান ছিল তাঁর হীরা, জহরৎ প্রভৃতি মূল্যবান পাথরের; আর এসব বিক্রি করে তাঁর লাভও হ’ত বেশ ভালরকম। কিন্তু যখন থেকে এই ছবিগুলো দোকানে সাজিয়ে রাখলেন তখন থেকে তা’র খরিদাররা এসে তাঁর এই সব চিত্রের দিকে মুগ্ধনেত্রে চেয়ে থাকত ও সেই চিত্রগুলোকে ও চিত্রকর গুটেনবার্গকে খুবই প্রশংসা করত। যারা নানা মূল্যবান পাথর ও মণিমুক্তা কিনতে আসত তারা ছবি দেখে মণিমুক্তা, জহরং প্রভৃতির কথা ভুলে গিয়ে ছৰি কিনেই বাড়ী ফিরত।
এই রকম কাণ্ড দেখে গুটেনবার্গ একদিন তাঁ’র স্ত্রীকে বললেন— “দেখ এনা, এরকম ছবি এঁকে দোকানে রাখলে আমার আসল ব্যবসা মাটি হয়ে যাবে দেখছি। দেখ আমার মনে হচ্ছে এই ছবি আঁকা কাজটি বন্ধ করে দেওয়াই ভাল।”
গুটেনবার্গের স্ত্রী বললেন – “দেখ তা করো না। এই ছবির কাজটি চলুক, এর পরে এই কাজটি এমন একটি বড় ব্যবসায়ে পরিণত হ’য়ে উঠতে পারে যে, উহা তোমার মূল্যবান হীরা, জহরতের কাজ হ’তেও সম্ভবত বেশি লাভজনক হয়ে উঠৰে। আমারত এই বিশ্বাস।এই কথা শুনে গুটেনবার্গ তাঁর নূতন ব্যবসাটি বন্ধ করে দেওয়ার মতলব ত্যাগ করলেন।এই ছবি অঙ্কনের নুতন আবিষ্কারটি গুটেনবার্গ অতি যত্নের সহিত গোপন করে রাখলেন।এর ভিতরকার কৌশলটি কা’কেও বলেন না।
একদিন গুটেনবার্গ তার স্ত্রীর পরামর্শ শুনে এই নূতন উপারে অঙ্কিত কয়েকটি চিত্র তাঁদের বাড়ীর নিকটবর্ত্তী মঠের পাদ্রিকে দেখালেন। পাদ্রি সাহেব সে সব ছবি দেখে পরম আনন্দিত হলেন ও তাঁর দোকানে যত ছবি ছিল সব কিনে নিয়ে এসে মঠের দেয়ালের গায়ে টাঙ্গিয়ে দিলেন।
একদিন পাদ্রি সাহেব গুটেনবার্গকে পার্চমেন্ট (purehment) কাগজে, সরের কলমে লেখা একখানি সুন্দর বই দিলেন। বইখানির নাম ছিল ‘সাধুজনের জীবনী। এ বইখানি প্রায় ৬০ পৃষ্ঠাব্যাপী ছিল। সম্পূর্ণ বইখানি লিখিয়ে নিতে অনেকদিন লেগেছিল।
বাড়ি এসে গুটেনবার্গ তাঁর স্বীকে বললেন – “দেখ এই বইয়ের সম পাতাগুলি আমি যেমন করে কাষ্ঠফলকের ওপর ছবি খোদাই করে ছেপে নিয়েছি ঠিক তেমনি করে ছেপে নেব।এ কথা শুনে তাঁর স্ত্রী বললেন “বাঃ চমৎকার বুদ্ধি ত তোমার মাথায় এসেছে। সে বড় এক আশ্চর্য জিনিষ হবে। তা করলে তুমি ও পাদ্রিদের মত বই বিক্রী করতেও পারবে। একবার কাঠের ওপর সব খোদাই করে নিতে পারলে তা’ থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এক একখানা বই ছাপা হ’য়ে যাবে । দেখ আর দেরী ক’রো না, শীঘ্র সে কাজে হাত দাও। এবার বোধ করি আমাদের ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন।”
এখন থেকে গুটেনবার্গ একান্তচিত্তে এই কাজে লেগে গেলেন। তাঁর প্রতিদিনকার কাজ শেষ হ’য়ে গেলে তিনি রাতের পর রাত বসে এই বই ছাপানোর কাজে নিযুক্ত থাকতেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া এই নূতন কাজের বিষয় তাঁর বাড়ীর কি দোকানের কেউ কিছু জানত না। কিছুদিন পরে একদিন সন্ধ্যাবেলায় যখন তিনি এইকাজে নিযুক্ত ছিলেন, এমন সময় তাঁর দুজন কর্মচারী হঠাৎ তাঁকে দেখতে পায়।তারা অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে বল্লে— “দেখুন আমাদের দয়া করে বলুন আপনি কোন্ নূতন কাজ আরম্ভ করেছেন।আমরা যথাসাধ্য আপনাকে এইকাৰ্য্যে সাহায্য করব। দরকার হয় টাকা- পয়সা দিয়েও আপনাকে সাহায্য করতে রাজি আছি।”
তিনি তা’দের সাধাসাধি ও অনুনয়-বিনয় অগ্রাহ্য করতে না পেরে দুজনকে একাজে যোগ দিতে অনুমতি দিলেন। এখন থেকে তাঁরা চারজনে মিলে এই খোদাই কার্য্যে লেগে গেলেন। দেখতে দেখতে এক একখানা কাঠফলকে এক একটি পৃষ্ঠার সমস্ত অক্ষর- গুলো খোদিত হয়ে গেল।যখন সমস্ত বইখানির খোদাই কাজ শেষ হয়ে গেল তখন গুটেনবার্গের স্ত্রী বললেন “এখন আমার কথা শোন, আমি যেমনটি বলছি এখন ঠিক সেইভাবে ছেপে নাও।”এনার কথামত তাঁরা প্রত্যেক পাতার একপিঠ ছাপলেন এবং দুটো পাতার খালি ছপিঠ আঠা দিয়ে জুড়ে দিলেন। এইভাবে সাধুর জীবনী ছাপা হয়ে গিয়ে তা’ বিক্রীর জন্য প্রস্তুত হ’ল ।
প্রথম সপ্তাহে গুটেনবার্গ মাত্র দুইখানি বই বিক্রী করলেন। তখন সাধারণ লোকে লেখাপড়া জানত না বলে’ বই বিক্রী তেমন কিছুই হ’ল না। যারা খুব অর্থশালী ছিলেন তাদের সঙ্গে দেখা করে বই বিক্রীর চেষ্টা করাটাও তখনকার দিনে খুব কঠিন ছিল।কিছু পারিবার ওটেনবার্গের বই কিনতে রাজী হলেন না।তারা বললেন তাদের দরকার বই তারা নিজেরাই লিখে নেবেন।
ইহার পরে গুটেনবার্গ পঞ্চাশ পৃষ্ঠার একখানি ব্যাকরণ ছাপলেন । এই বইখানি ছাপা হওয়া মাত্রই তার সব “কপি” বিক্রী হয়ে গেল। কারণ ব্যাকরণখানি গির্জার স্কুলের ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক ছিল । আর হাতেলেখা ব্যাকরণ যা’ ছেলেদের তখন কিনতে হত তার চাইতে এর দামও ঢের কম ছিল। গুটেনবার্গ এবার খুবই উৎসাহিত হয়ে আরও দুইখানি ধর্ম্মপুস্তক ছেপে নিলেন।
এ দু’খানি বই তখনকার দিনের পাদ্রিদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। পাদ্রিরা এত অল্পসময়ের মধ্যে এ দু’খানি বই লেখার কাজ শেষ হ’তে দেখে একেবারে বিস্মিত করে গেলেন। তারা গুটেনবার্গকে বলেন- “আপনি “তিন সপ্তা পরে পরে চারখানি করে বই নিয়ে আসেন, নিশ্চয় আপনি কোন ভেল্কিবাজি জানেন। আমাদের লেখকদের বই লিখতে যে সময় লাগে আপনি তার অর্দ্ধেক সময়ের মধ্যে বই লিখে আনেন এ বড়ই আশ্চর্য! বলুন দেখি, আপনি কি ক’রে এ কাজ সম্ভব করে তোলেন ?গুটেনবার্গ একটুখানি হেসে নীরব হয়ে রইলেন।
সেই মঠের প্রধান ধর্ম্মযাজক যিনি গুটেনবার্গের সবগুলো ছবি কিনে নিয়েছিলেন তিনি অতিশীয়ই এর ভিতরকার ব্যাপারটা অনুমান করে নিলেন। তিনি গুটেনবার্গকে বললেন “দেখুন আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি সেই ছবিগুলো যে উপায়ে ছেপেছিলেন, এই বইগুলিও নিশ্চয়ই সেই কৌশলেই ছেপেছেন। আচ্ছা, এবার আপনি আমাকে একখানি বাইবেল ছেপে দিন। ”
গুটেন্ৰাগ প্ৰধান পাদ্রিকে বললেন সে কাজের জন্য তাঁকে যদি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়,তবে তিনি সে কাজ হাতে নিতে পারেন। পাদ্রিসাহেব তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হওয়াতে তিনি সেই কাজ গ্রহণ করলেন। বাড়ীতে ফিরে এসে তিনি তাঁর স্ত্রীর সহিত এবিষয়ে অনেকক্ষণ পরামর্শ করলেন। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন “দেখ এই বইখানি হ’ল সাতশ পৃষ্ঠাব্যাপী। যদি আমি আমার অবসর সময়ে বসে এ কাজ করি, তবে মাসে দু’পৃষ্ঠামাত্র খোদাই করতে পারব। আর সমগ্র বাইবেলখানির কাজ শেষ করতে আমার লাগবে পুরোপুরি তিরিশ বছর!”
এনা একটু চিন্তা করে বললেন – “হাঁ, তুমি যদি এ কাজ একা করতে যাও তবে ত তুমি বইখানি শেষ করবার আগেই বুড়ো হয়ে যাৰে । আচ্ছা, এক কাজ কর না কেন, তোমার আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে একাজটি শীঘ্র শেষ করে ফেল না।”
এনার কথা শুনে এবার গুটেনবার্গ তাঁ’র কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একাজে নিযুক্ত হ’লেন । যখন প্রথম পৃষ্ঠার ব্লকখানি প্রায় শেষ হ’য়ে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ তাঁর হাত থেকে ছুড়িখানি ব্লকটির ওপর পড়ে গিয়ে তাকে দু’খানা করে দিলে। হায়! হায়! গুটেনবার্গের এত পরিশ্রমের কাজ নিমেষে নাই হয়ে গেল।গুটেনবার্গ একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন,’ও মাথায় হাত দিয়ে তাঁর এই দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলেন। অনেক সময় দেখা যায় যা মঙ্গল তা আমাদের কাছে উপস্থিত হয় বিপদের রুপ ধরে গুটেনবার্গের জীবনেও হ’ল তাই।
এই আকস্মিক বিপদের কথা চিন্তা করতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা চমৎকার বুদ্ধির উদয় হ’ল। তিনি ভাবলেন যে ভাঙ্গা ব্লকটিতে খোদাই করা প্রত্যেক অক্ষরটি যদি কেটে কেটে আলাদা করে নেওয়া হয় এবং সেই অক্ষরগুলো পৃথক ভাবে ব্যবহার করা হয় তবে ত মুদ্রাঙ্কণকাৰ্য্য খুব সহজে এবং সুন্দরভাবে হ’তে পারে। কোরিয়াতে এর দুশ বছর আগে কাঠের ও মাটির অক্ষর পর পর সাজিয়ে নিয়ে বই ছাপান হ’ত।
গুটেনবার্গ কিন্তু এই খবর মোটেই জানতেন না। এই অভিনব আবিষ্কারটি তার মধ্যে খুৰ একটি নূতন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃজন করে তুললো; এবার গুটেনবার্গ ও তাঁর বন্ধুরা মিলে এক একটি অক্ষর আলাদা আলাদা খোদাই করে স্তূপাকার ক’রে ফেললেন। এরকম অক্ষরগুলোকে বলা হয় “টাইপ”। গুটেনবার্গ প্রথম এইরূপ কতকগুলো “টাইপ” পর পর সাজিয়ে তা’ বেশ শক্ত করে একগাছা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিলেন। এই অক্ষর গুলো দিয়ে প্রথম ছেপে নিলেন দুটি শব্দ— “ভাল লোক”। তিনি এবার এক একটি বিশেষ অক্ষরের জন্য পৃথক করে এক একটি বাক্স তৈরি করলেন এবং পরে এইরূপ টাইপ থেকে সহজে ছাপ নেওয়ার জন্য একখানি ছোট্ট কাঠের মুদ্রাযন্ত্র (press) নির্মাণ করে নিলেন।
এই সময়ে গুটেনবার্গের একজন অংশীদার-বন্ধুর মৃত্যু হয়। সেই বন্ধুর মৃত্যুর পরে তাঁর উত্তরাধিকারীরা এই নূতন ছাপাখানার অংশ দাবী করে বসেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় গুটেনবার্গের ছাপাখানাটা তাঁর যে বন্ধু মারা যান, তাঁরই বাড়ীর একাংশে স্থাপিত ছিল।“হায়! হায়! এরা আমার নূতন উদ্ভাবিত মুদ্রাযন্ত্রের সমস্ত গোপন কৌশলটি জেনে নিয়ে আমার সর্ব্বনাশ করবে”—এই বলে গুটেনবার্গ একটা হাতুড়ী দিয়ে তাঁর সযত্নে তৈরি টাইপগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। গুটেনবার্গ এবার এসব কাজ ছেড়ে দিয়ে আবার তাঁর পুরাণো ব্যবসায়ে মন দিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী বার বার তাকে বললেন যে মুদ্রণযন্ত্রের কাজটি যেন তিনি আবার নূতন করে আরম্ভ করেন ।
এবার গুটেনবার্গ তাঁর জন্মভূমি মেন্ঝ সহরে ফিরে এলেন। তিনি ভাবলেন এখানে তাঁর নবোদ্ভাবিত মুদ্রাযন্ত্রের কৌশলাদির কোন কথাই কেউ জানে না। এখানে থেকেই তিনি তাঁর সেকাজ আবার শুরু করলেন। এই সময়ে মেন্ঝ সহরে ফাস্ট নামে এক ধনীর সঙ্গে ঘটনাক্রমে তাঁর পরিচয় হয়। গুটেনবার্গ তাঁর কাছে এই মুদ্রাযন্ত্র সম্বন্ধীয় সব কথাই খুলে বলেন। ফাস্ট ও সমস্ত কথা শুনে খুবই উৎসাহিত হলেন এবং গুটেনবার্গকে বললেন- “দেখুন আমি আপনাকে তিন হাজার ফ্লোরিন (প্রায় তিন হাজার টাকা) এ কাজের জন্য ধার দিচ্ছি, আপনি আমাকে আপনার এই ব্যবসায়ের অংশীদার করে নিন।”
গুটেনবার্গ তাঁর এই প্রস্তাবে স্বীকৃত হ’লেন। তিনি এবার একটি বড় বাড়ী নিয়ে তাঁর মুদ্রণ কার্য আবার আরম্ভ করে দিলেন। পিটার শোফার নামে আর একজন লোক তাঁদের সঙ্গে এবার যোগ দেন এবং পরে এই ব্যবসায়ের একজন অংশীদার হন। পিটার শোফার এই মুদ্রাযন্ত্রের আরম্ভকালে গুটেনবার্গকে খুবই সাহায্য করেন। শোফারের বুদ্ধি- কৌশলে এই মুদ্রাযন্ত্রের আরও নানাদিক দিয়ে বিবিধ উন্নতি সাধিত হয় ।
এই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করবার কিছুদিন পরে তাঁরা দেখলেন যে কাঠের “টাইপ”-গুলোতে বার বার কালি লাগলে তা’ নরম হয়ে যায় এবং তাতে পরে আর পরিষ্কার ছাপ পড়ে না । পিটার ও গুটেনবার্গ অনেক ভেবেচিন্তে এই প্রধান অসুবিধাটি দূর করবার জন্য দস্তা ও অ্যান্টিমনি এই দুই ধাতুতে মিলিয়ে এক নূতন মিশ্রধাতু তৈরি করে তা দিয়ে টাইপ করতে শুরু করলেন। এই নুতন টাইপগুলো চমৎকার হল। টাইপগুলো খুব টেকসই হোল এবং তা’তে মুদ্রাঙ্কণকার্য ও খুব সুন্দর ও নিখুঁত হ’তে লাগল।
১৪৫০ পৃষ্ঠাকে তাঁরা প্রথম প্রসিদ্ধ মেঝেরিন্ ( mazarin ) বাইবেল মুদ্রণের কাজ আরম্ভ করলেন। এই বাইবেলখানির মুদ্রণ- কার্য্য শেষ করতে তাদের পুরোপুরি পাচ বছর লাগে। কিন্তু এ কাজে তাঁদের যেরূপ লাভ হবে আশা করেছিলেন তার কিছুই হ’ল না। ফাস্ট গুটেনবার্গের ব্যবসায়-বুদ্ধি দেখে বড়ই নিরাশ হয়ে পড়লেন। তিনি গুটেনবার্গের ওপর বিরক্ত হয়ে শোফারকে হাত করবার জন্য তাঁর খুব তোষামোদ আরম্ভ করলেন।
তিনি শোফারকে বললেন “দেখ গুটেনবার্গ এই ছাপাখানার যন্ত্রে আর এমন কি-ই বা করেছে, তুমিই ত নুতন কালি ও টাইপ প্রভৃতি তৈরি করে মুদ্রাযন্ত্রের যথেষ্ট উন্নতি বিধান করেছ। চল. আমরা গুটেনবার্গকে তাড়িয়ে দিয়ে এ ব্যবসাটা আমাদের দুজনকার করে নিই।গুটেনবার্গ অনেক বাজেকাজে অনর্থক ঢের টাকা নষ্ট করছে।ও যদি এভাবে টাকা খরচ করে তবে ত সে কিছুতেই আমার ঋণশোধ করতে পারবে না।”
শোফার ভাবলেন যদি তিনি ফাস্টের কথামত কাজ করেন,তবে গুটেনবার্গের প্রতি ভয়ানক অন্যায় ও অকৃতজ্ঞ ব্যবহার করা হয়। আবার ফাটের নাতনীকে শোফার খুব ভালবাসতেন বলে’ ও ফাস্টের নাতনীর সঙ্গে শোফারের এই সময় বিয়ের কথাবার্তা চলছিল বলে তিনি ফাস্টকেও অসন্তুষ্ট করতে চাইলেন না ।
ফাস্ট গুটেনবার্গকে বললেন “গুটেনবার্গ, আমার টাকা যা ধার করেছ তা’ এখন পরিশোধ করে দিতে হবে,আমি আর কোন ওজর-আপত্তি শুনতে চাই না বলে রাখছি। গুটেনবার্গ বড়ই অধীর হ’য়ে বিনীতভাবে তাকে বললেন “আপনি কি আমার সর্ব্বনাশ করতে চান, আপনি ত জানেন এখন আমার হাতে টাকাপয়সা মোটেই নেই।
রাগে অন্ধ হয়ে ফষ্টি বলে উঠলেন “ তোমাকে এক মাসের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করতেই হবে, আমি আর কোন কথা শুনব না। ”গুটেনবার্গ অনেক কাকুতি-মিনতি করে ফাস্টকে বললেন যেন ফাস্ট তাঁর সর্ব্বনাশ না করেন। কিন্তু ফাস্ট তাঁর কোন কথায় কর্ণপাত করলেন না। এইদিকে ফাস্ট সুদ ও আসল সহ সব টাকার জন্য নালিশ করে ছাপাখানা ও তাঁর সমস্ত সাজসরঞ্জাম এবং যত সব বই এ পর্যান্ত ছাপাখানা হতে মুদ্রিত হয়েছিল,তা সমস্তই নিজে দখল করে নিলেন।
গুটেনবার্গ এবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়লেন।যিনি এই মুদ্রাযন্ত্র উদ্ভাবন করলেন ও তার উন্নতির জন্য এতদিন পরে প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন, হায়! তাকে আজ একেবারে রিক্তহস্তে পথে এসে দাড়াতে হ’ল। এই নিষ্ঠুর পরিহাস! গুটেনবার্গ মৰ্ম্মবেদনায় একান্ত কাতর হয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে বললেন— “এরা আমার নুতন উদ্ভাবনটি কেড়ে নিল। হায়! আমার আর কিছুই রইল না। কিছুদিন পরে শোফার ফাস্টের নাতনীকে বিয়ে করলেন এবং তিনি ও ফাস্ট দুজনে ছাপাখানার কাজ চালাতে লাগলেন ।
কিছুকাল পরে ফাস্ট এই ছাপাখানার কাজ প্রচার করবার জন্য ফ্রান্সে গেলেন। তিনি ফ্রান্সে গিয়ে প্রথম ফ্রান্সের রাজার কাছে একখানি মুদ্রিত বাইবেল ৭৫ ক্রাউন মূল্যে বিক্রী করলেন। কি করে এমন বই মুদ্রিত হ’ল এ নিয়ে ফ্রান্সে বেজায় জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। চারদিকে সকলে বলে বেড়াতে লাগল যে ফাষ্ট নিশ্চয়ই কোন ভেল্কী জানে ও কোন ভূতপ্রেতের সাহায্যে খুব সম্ভবত এমন অসাধ্য সাধন করেছে।তখনকার দিনে ইউরোপের লোকেরা ভূতপ্রেত-উপদেবতার ওপর খুবই বিশ্বাসবান ছিল।একটি-কিছু আশ্চর্য্য জিনিষ দেখলেই মনে করত নিশ্চয় তা’ কোন উপদেবতার কাজ। এইত ছিল তখনকার দিনে ইউরোপের বুদ্ধির দৌড়!
ফাষ্টকে এবার ফ্রান্সের রাজদরবারে ধরে নিয়ে আসা হল এবং রাজা তাঁকে আদেশ করলেন যে, এরূপ বই কিরূপে ছাপা হ’ল তা যেন তিনি খুলে বলেন। কোন মন্ত্রবলে উপদেবতাকে বশিভূত করে এমন অদ্ভূত কাৰ্য্য সাধন করেছেন একথাও বোধ করি রাজদরবারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। ফাস্টকে অগত্যা সব কথাই খুলে বলতে হ’ল।
কোন যন্ত্রের সাহায্যে কি উপায়ে বই ছাপান সবকথাই তিনি বললেন, কিন্তু বললেন না শুধু একটি কথা সেটি হচ্ছে গুটেনবার্গের কথা। গুটেনবার্গই যে এই মুদ্রান্ত্রের প্রথম উদ্ভাবন করেন একথাটি গোপন করে তিনি সেখানে বললেন তিনিই সেই যন্ত্রের উদ্ভাবন করেছেন। সকলেই মুদ্রাযন্ত্রের কাহিনী শুনে ফাস্টকে অত্যন্ত প্রশংসা করতে লাগল। যে সম্মান গুটেনবার্গের প্রাপ্য ছিল, সে সম্মান ও শ্রদ্ধা নিজে লাভ করে ফাস্ট মেন্ঝ শহরে ফিরে এলেন ।
অনেকদিন পরে ফাস্টের কি জানি কেন ওঠাৎ একদিন ধর্মজ্ঞানের উদয় হ’ল। তাঁর ধর্ম্মবুদ্ধি জেগে উঠবার পরে তিনি বুঝতে পারলেন গুটেনবার্গের প্রতি তিনি কি ভয়ানক অন্যায় ব্যবহার করেছেন। তাঁর এই অপরাধের জন্ম গুটেনবার্গের নিকট তিনি পরে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং তাঁকে বিশেষ করে অনুরোধ করলেন যে, তিনি মুদ্রাযন্ত্রের ব্যবসায় পূর্ব্বে যে আসন অধিকার করেছিলেন এখন আবার যেন তাঁর পূৰ্ব্বতন আসন গ্রহণ করেন। কিন্তু গুটেনবার্গ তাঁর সেই অনুরোধ রক্ষা করলেন না। আট বছর ধরে গুটেনবার্গ তাঁর নিজের আর একখানা ছাপাখানা চালাচ্ছিলেন ও তা’তে তাঁর বেশ লাভও হচ্ছিল। এই সময় হঠাৎ তাঁর একান্ত অনুরক্ত স্ত্রী এনার মৃত্যু হয়।
এনার মৃত্যুতে গুটেনবার্গ একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়লেন—কোন কার্য্যে তার আর উৎসাহ রইল না। তিনি তাঁর সমস্ত কাজকৰ্ম্ম পরিত্যাগ করে শোকাহত চিত্ত নিয়ে দেশভ্রমণে বেরুলেন। ইউরোপের সকলেই এই সময় জানতে পারল যে ওটেন্ৰাৰ্গই মুদ্রণযন্ত্রের উদ্ভাবনকর্তা। এই অমূল্য উদ্ভাবনের জন্য সমগ্র ইউরোপবাসীয় শ্রদ্ধা ও সম্মানের স্বর্ণমুকুট এবার তিনিই লাভ করলেন। জার্মানির রাজা গুটেনবার্গের জন্য একটি জীবনবৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন। গুটেনবার্গ এই বৃত্তি লাভ করে তার জীবনের অবশিষ্ট কাল আরামে ও শাস্তিতে অতিবাহিত করেন। এই সময়ে জার্মানির প্রায় প্রত্যেক শহরে, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইটালির নানা জায়গায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে বহুবিধ পুস্তক মুদ্রিত হতে আরম্ভ হয় ।
আগে মুদ্রণযন্ত্রগুলো কাঠ দিয়ে তৈরি হ’ত। এরূপ কাঠের তৈরি মুদ্রণযন্ত্র প্রায় ৩৫ বছর কাল প্রচলিত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাসে ষ্টেন্হোপ, লোহার মুদ্রাযন্ত্রের প্রথম উদ্ভাবন করেন। পরে এই লোহার মুদ্রণযন্ত্রের নানাদিক দিয়ে নানারকমের উন্নতি সাধিত হয়ে তা বর্তমান কালের মুদ্রণযন্ত্রের আকার ধারণ করেছে।
এখনকার দিনে মুদ্রণযন্ত্র এমন সুন্দর হ’য়ে উঠেছে যে, টাইপগুলিও এখন যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি হচ্ছে, তা সাজিয়ে বসানও হ’চ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে, সেই টাইপে আবার কালিও লাগান হয় যন্ত্রের দ্বারা এবং তা’ কাগজে ছাপা হয়ে সেই মুদ্রিত কাগজখানিও যন্ত্রের কৌশলেই ঠিকমত ভাঁজ হয়ে আপনা হ’তে মুদ্রাযন্ত্র হ’তে সুন্দর ও সহজভাবে বেরিয়ে আসে। এখনকার দিনের রোটেরী যন্ত্র, লাইনোটাইপ যন্ত্র ও মনো-টাইপ যন্ত্র প্রভৃতি মুদ্রণকার্যকে খুব সহজ ও সুলভ করে তুলে মুদ্রণযন্ত্রের ইতিহাসে এক নবযুগের রচনা করেছে।
Please click on one Add to help us
মহাশয়, জ্ঞান বিতরণের মত মহৎ কাজে অংশ নিন।ওয়েবসাইট টি পরিচালনার খরচ হিসেবে আপনি কিছু অনুদান দিতে পারেন, স্পন্সর করতে পারেন, এড দিতে পারেন, নিজে না পারলে চ্যারিটি ফান্ডের বা দাতাদের জানাতে পারেন। অনুদান পাঠাতে পারেন এই নম্বরে ০১৭২৩১৬৫৪০৪ বিকাশ,নগদ,রকেট।
এই ওয়েবসাইট আমার নিজের খরচায় চালাই। এড থেকে ডোমেইন খরচই উঠেনা। আমি একা প্রচুর সময় দেই। শিক্ষক হিসেবে আমার জ্ঞান দানের ইচ্ছা থেকেই এই প্রচেষ্টা। আপনি লিখতে পারেন এই ব্লগে। এগিয়ে নিন বাংলায় ভালো কিছু শেখার প্রচেষ্টা।