ফাঁসি দিলে মানুষের মৃত্যু কিভাবে হয়?

ফাঁসি দিলে মানুষের মৃত্যু কিভাবে হয়?

ছোটবেলায় নায়ক সালমান শাহ অভিনীত “সত্যের মৃত্যু নাই” ছবিতে নায়কের ফাঁসির মঞ্চে ফাঁসি দেয়ার দৃশ্য দেখে অনেকের কান্না দেখেছি। আবার “কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির দৃশ্য দেখে অনেক বাঙালী দর্শক চোখের জল ফেলেছে।

অনেক ছবিতে এরকম ফাঁসির দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায়। অনেকের পরিচিতজন ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করে। এসব দেখে আমাদের মনে সভাবতই প্রশ্ন জাগে ফাঁসি দিলে মানুষ মরে যায় কেন?

আপনি আরো পড়তে পারেন… রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের রক্ত নিলে মৃত্যু হতে পারে!! ….. এন্টিভেনম বা সাপের বিষের ঔষধ কিভাবে বানায়?

ফাঁসি দিলে মানুষের মৃত্যু কিভাবে হয়?

ফাঁসি দিলে মানুষের শরীরে কিছু বিশেষ পরিবর্তন তৈরি হয় যার কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই বিশেষ শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলো হলো-

১)ফাঁসি দিলে ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়

আমাদের দেহে পিঠের মাঝবরাবর লম্বা একটি হাড় থাকে একে মেরুদন্ড বলে। মেরুদন্ড ৩৩টি ছোটছোট হাড় নিয়ে গঠিত। এই ছোট হাড়গুলোর প্রত্যেকটিকে বলে কশেরুকা বা ভার্টিব্রা। কশেরুকা ৫ ধরণের। মাথার খুলির নিচ থেকে কাধ পর্যন্ত অর্থাৎ গলার পেছনের অংশে ৭টা সারভাইকাল ভার্টিব্রা বা গ্রীবাদেশীয় কশেরুকা থাকে।

এই কশেরুকা গুলোর ভেতরের অংশে ফাঁপা নলাকার নিউরাল নালী থাকে। নিউরাল নালীর ভেতরে পশ্চাৎ মস্তিষ্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মেডুলা অবলংগাটা থাকে। এটি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।

মেডুলা অবলংগাটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটবে। ২য় নং গ্রীবাদেশীয় কশেরুকার নাম অ্যাক্সিস(Axis)।অ্যাক্সিস কশেরুকার শীর্ষ বেশ সূচালো।

অ্যাক্সিস
অ্যাক্সিস

কোন মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলে অথবা নিজেই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে গেলে দেহের সমস্ত ভার গলার পেছনে অবস্থিত গ্রীবাদেশীয় কশেরুকার উপর কেন্দ্রীভূত হয়। দেহের ওজন হঠাৎ কশেরুকার উপর পরার ফলে তিব্র চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপে অ্যাক্সিস কশেরুকা নিজ স্থান থেকে সরে যায় এবং সূচালো অগ্রভাগটি মস্তিষ্কের মেডুলা অবলংগাটায় খোঁচা দেয়।

ফাঁসি দিলে ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়
ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায়

এই তিব্র যন্ত্রনাদায়ক খোঁচার কারণে মেডুলা অবলংগাটা ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় মানুষ শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলেও আর শ্বাস নিতে পারে না। হাত পা ছোড়াছুঁড়ি করতে থাকে। অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে মৃত্যুবরণ করে।যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনোকে প্রসাব করে ফেলে।

আপনি জানলে অবাক হবেন যে, ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করার সময় আসামির দেহের ওজন পরিমাপ করে নেয়া হয় এবং সেই অনুপাতে মঞ্চের পাটাতনের নিচের ফাঁকা স্থানের গভীরতা ঠিক করা হয়।

যাতে জল্লাদ লিভার টানার সাথেসাথে আসামির দেহ খুব জোড়ে নিচে পরে তীব্র চাপের সৃষ্টি হয় এবং এই চেপে ঘাড়ের হাড় ভাঙা নিশ্চিত হয়। আহ্ কি নিষ্ঠুর জল্লাদ মামা!!

২)ক্যারোটিড ধমনির পথ বন্ধ হয়ে যায়

মানুষের মগজে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে ক্যারোটিড ধমনি। ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিলে দেহের ওজনের কারণে এই ধমনিতে চাপ পরে। ধমনির উপর চাপের কারণে মগজে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
মস্তিষ্কের কোন টিস্যুই অক্সিজেন এর সরবরাহ ছাড়া বাঁচতে পারে না। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবে সেরেব্রাল হাইপোক্সিয়া হয়(মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবজনিত অস্বাভাবিক অবস্থা)। এর প্রভাবে মস্তিষ্কের টিস্যুগুলো মারা যেতে শুরু করে। একসময় মানুষটির মৃত্যু ঘটে।

ফাঁসি দিলে ক্যারোটিড ধমনির পথ বন্ধ হয়ে যায়
ক্যারোটিড ধমনি

৩)শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যায়

ফাঁসি দেওয়ার সময় মাথা এমন এক অবস্থানে থাকে যেখান থেকে শ্বাস নেওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। গলায় প্রচণ্ড চাপের ফলে শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাসনালী বন্ধ হলে দম আটকে মানুষের মৃত্যু ঘটে।
এসময় মানুষ একটু শ্বাস নেয়ার জন্য হাত-পা ছুড়ে ছটফট করতে থাকে ফলে জিহ্বা মুখগহ্বর থেকে বের হয়ে আসে। শেষে জিহ্বা আর মুখগহ্বরে ঢুকে যায় না, দুই চোয়ালের দাঁতের ফাঁকে আটকে যায়।
এই জন্যে ফাঁসিতে ঝুলে মরা মানুষদের আমরা জিহ্বা কামড়ে ধরা অবস্থায় দেখতে পাই।

ফাঁসি দিলে শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যায়
শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যায়

৪) সুষুম্নাকাণ্ড ভেঙে যায়

সারভাইকাল ফ্রাকচার বা ঘাড় ভেঙে গিয়ে স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্নাকাণ্ড মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে মৃত্যু ঘটে।

ফাঁসি দিলে সুষুম্নাকাণ্ড ছিড়ে যাওয়া
সুষুম্নাকাণ্ড ছিড়ে যাওয়া

৫) হার্ট এটাক হয়

মানুষের ঘাড়ের কাছে ক্যারোটিড সাইনাস নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থাকে। এটি থেকে মানুষের হৃদপিন্ডেরর কাজ সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় স্নায়ু উদ্দিপনা পরিবাহিত হয়। ক্যারোটিড সাইনাসে যখন চাপ পড়ে তখন হৃদপিন্ডে রক্তসঞ্চালন ধিরেধিরে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মানুষের হৃদপিন্ড কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
এই অবস্থাকে হার্ট এটাক বলে। হার্ট এটাকে ফাঁসির আসামি বা আত্মহত্যাকারীর মৃত্যু ঘটে।

ক্যারোটিড সাইনাস
ক্যারোটিড সাইনাস

৬) মস্তিষ্কে কার্বনডাইঅক্সাইড বেড়ে যায়

জুগুলার শিরা মস্তিষ্ক থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড জোগাড় করে নিয়ে আসে। এই শিরা ঘাড়ের দুই পাশ দিয়ে মাথার খুলির ভেতরে প্রবেশ করে। ফাঁসিতে ঝোলানো হলে ফাঁসির দড়ি ঘাড়ের উপর চেপে শক্তভাবে চেপে বসে ফলে এই শিরার পথ বন্ধ হয়ে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
জুগুলার শিরা বন্ধ হলে মস্তিষ্ক থেকে কার্বনডাইঅক্সাইডযুক্ত রক্ত ফেরত আসে না এজন্য মস্তিষ্কে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়।এতে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মারা যেতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে মানুষেরও মৃত্যু ঘটে।

জুগুলার শিরা
জুগুলার শিরা

ফাঁসি দিলে যদি মারা যাওয়ার এতগুলো কারণ সৃষ্টি হয়,তাহলে ফাঁসির আসামির মারা না গিয়ে কোন উপায় আছে? আপনি কি বলেন?

ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করলে কতটা কষ্ঠ পায়?

ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করলে কতটা কষ্ঠ পায়?

গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলার পর যখন গলার হাড় ভেঙে যায় তখন কি পরিমাণ কষ্ঠ হয় তা আত্মহত্যাকারী ছাড়া আর কেউ জানে না। অ্যাক্সিস ভেঙে মগজে খোঁচা দেয়ার সাথে সাথে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সারাদেহে ছড়িয়ে পরে।
যন্ত্রনার চোটে মানুষ করুণ সুরে গোঙাতে থাকে।শ্বাসনালী বন্ধ হওয়ার কারণে এক রত্তি বাতাস নেয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে ফলে লম্বা জিহ্বা বের করে ফেলে কিন্তু বাতাস আর নিতে পারে না।

অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে প্রসাব-পায়খানা করে ফেলে।এবার ভাবুন জীবনে আগত কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে এমন যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যকে আলিঙ্গন করবেন না সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করে জীবনকে উপভোগ করবেন?

Fasi dile manusher mrittu kivabe hoy?

Fasi dile mittu hoy keno? Manush ke fashi dile kivabe more? Fashir asami kivabe more? Fashi die suicide korle kivabe more? Fasi die suicide korle kemon kosto hoy?

শ্রেয়সী সাহা
ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে MBBS করেছেন।এই লেখকের লেখার ছায়া অবলম্বনে লেখাটি লেখা হয়েছে।

All photo credit Goes to sutterstock.com

Please Click On Just One Add To Help Us

মহাশয়, জ্ঞান বিতরণের মত মহৎ কাজে অংশ নিন।ওয়েবসাইট টি পরিচালনার খরচ হিসেবে আপনি কিছু অনুদান দিতে পারেন, স্পন্সর করতে পারেন, এড দিতে পারেন, নিজে না পারলে চ্যারিটি ফান্ডের বা দাতাদের জানাতে পারেন। অনুদান পাঠাতে পারেন এই নম্বরে ০১৭২৩১৬৫৪০৪ বিকাশ,নগদ,রকেট।

এই ওয়েবসাইট আমার নিজের খরচায় চালাই। এড থেকে ডোমেইন খরচই উঠেনা। আমি একা প্রচুর সময় দেই। শিক্ষক হিসেবে আমার জ্ঞান দানের ইচ্ছা থেকেই এই প্রচেষ্টা। আপনি লিখতে পারেন এই ব্লগে। এগিয়ে নিন বাংলায় ভালো কিছু শেখার প্রচেষ্টা।