ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়া থাকতো কোন প্রাণী মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে? উত্তর সবার নখদর্পনে থাকতো।ঝটপট উত্তর – বাদুড়। অনেকে আবার গালি দেয়ার জন্য বলে বাদুড়ের মত যে পথে খাস সে পথেই ত্যাগ করিস!!!! কিছুদিন আগে হুজুর ওয়াজের মধ্যেও বলে ফেল্লেন যে কি এক অভিশাপের ফলে নাকি বাদুড় মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে।
আপনি আরো পড়তে পারেন… বাদুড় উল্টো হয়ে ঝুলে কেন?
মুখ দিয়ে হাক্কা দেয়ার এই বিশ্রী কাজের জন্য বাদুড়কে যখন ঘৃণা করা হচ্ছে নিকৃষ্ট প্রাণী হিসেবে তখন প্রাণী প্রেমী হিসেবে আর বসে থাকতে পারলাম না চলে এলাম বাদুড় মিয়াকে দোষমুক্ত করতে। যাইহোক আপনি কি সত্যি এটা বিশ্বাস করেন যে, বাদুড় মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে? তাহলে আসুন সত্য তথ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর শুরু করা যাক….
বাদুড় কি মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে?
আপনি যেমন খাবার মুখের ভেতর চিবিয়ে গলার মধ্য দিয়ে পাঠিয়ে দেন পেটের মধ্যে আবার হজম শেষে পায়ুপথে টয়লেটে গিয়ে মল অপসারণ করেন, ঠিক তেমনিভাবে বাদুড় মুখ দিয়ে খাবার গিলে আর পায়ুপথে মল অপসরণ করে।
এদের পৌষ্টিক নালি মুখ থেকে শুরু হয়ে পায়ু ছিদ্রে শেষ হয়। যেহেতু হাক্কা দেয়ার জন্য বাদুড়ের পায়ু ছিদ্র আছে তাহলে কেন সে মুখ দিয়ে মলত্যাগ করবে? আমরা এদের উল্টা হয়ে ঝুলে থাকতে দেখি তাই মাথায় এই ভাবনা স্থায়ী ভাবে গেঁথে গেছে যে এরা হয়তো উল্টো হয়ে ঝুলে মলত্যাগ করে।
আসলে এরা ঝুলে থাকার সময় কখনো মলত্যাগ করে না। মলত্যাগের সময় এরা উল্টো অবস্থান পরিবর্তন করে উড়ে উঠে তারপর মলত্যাগ করে আবার আগের অবস্থায় চলে আসে। মানে টয়লেটে যাওয়ার মত একটা অবস্থা।
কিছু ফল আমরা খোঁসাসহ খাই আবার কিছু ফল খোঁসা ছিলে খাই। ফলের খোঁসা আমরা হজম করতে পারিনা তবুও খাই।কিন্তু এরা ফলের খোঁসা হজম করতে পারেনা তাই কখনই খোঁসা খায় না। ফল খাবার আগে খোঁসা ছিলে মুখ দিয়ে ফেলে দেয় তারপর পাকা ফলের রস চুষে খায়।এটা দেখেই মানুষ মনে করে এরা মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে।
এমনকি এরা প্রসাব করার সময় উড়ে উঠে তারপর প্রসাব করে আবার উল্টো হয়ে ঝুলে পরে। একটু আলসে যে এরা সেটাও দেহের পশ্চাৎভাগ ভাঁজ করে প্রসাব স্প্রে করে দেয় যাতে মুখে এসে না পরে।
আমাদের অজ্ঞানতার কারণে অযথা এই মশাইকে মুখ দিয়ে মলত্যাগ করার মত জঘন্য অপবাদ দেই।
সবই তো বুঝলেন মনেহয় তাহলে এবার বলুন এ প্রশ্নের উত্তর কি হবে ” বাদুড় কি মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে? “
বাদুড় সম্পর্কে অজানা তথ্য
আসল পরিচয়
বাদুড় পাখি নয়। এটি একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। পৃথিবীতে একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী হলো বাদুড় যারা উড়তে পারে। চামচিকা বাদুড়ের জ্ঞাতি ভাই।
নকল ডানা
এদের আসলে পাখির মত ডানা নেই। আমরা যেটাকে ডানা ভেবে ভুলকরি সেটা আসলে ডানার বিকল্প। এটাকে প্যাটাজিয়াম বলে।
আমাদের মতই এদের হাত ও আঙ্গুল আছে। বুক ও পিঠের পার্শ্বদেশ থেকে দেহের চামড়া বর্ধিত হয়ে কনুই পর্যন্ত ঢেকে থাকে, অন্যদিকে হাতের আঙ্গুলের মাঝে ফাঁকা স্থানও চামড়া দিয়ে যুক্ত।
এই অতিরিক্ত চামড়ার পাতলা আবরণের কারণে এদের হাতের গঠন ডানার মত হয়ে গেছে। পাখির ডানা আর বাদুড়ের ডানা সমবৃত্তীয় অঙ্গ, মানে কাজ একই কিন্তু গঠন ভিন্ন।
গুষ্ঠি উদ্ধার
বাদুড়ের ইংরেজি নাম Bat এটা সবাই জানি কিন্তু এদের আরেকটি ইংরেজি নাম আছে তাহলো “Flying Fox” এটা বোধহয় কম লোকেই জানে। Flying Fox এর বাংলা করলে অর্থ হয় “উরন্ত শৃগাল”।
হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন মাথার দিক দিয়ে এরা শেয়ালের জ্ঞাতি ভাই। এদের মাথাটা কেটে নিলে দেখতে একদম শেয়ালের মতই লাগে। বিবর্তনের ফলে শেয়ালের কোন বংশধর বাদুড়ে পরিণত হয়েছে।
কৃষকের বন্ধু বাদুড়
শুধু ফল খেয়েই তৃপ্ত হয় না,বিভিন্ন ফুলের মধু পান করে এরা। পৃথিবীর প্রায় ২০% ফুলের পরাগায়ন ঘটে এদের সাহায্যে। এরা না থাকলে অনেক ফুল আর ফলে পরিণত হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কলার ফুলে পরাগায়ন ঘটায় এরা। এরা সাদা ফুলে আকৃষ্ট হয় এবং মধু পান করে।
ফলের রসে বেশি মজা
এরা ফলের রস পান করতে বেশি পছন্দ করে তাই খেঁজুর রসের হাঁড়িতে এরা হানা দিতে কসুর করে না। এদের রুচির তারিফ করতে হয়।
বাদুড়ের হাত পা
এদের ডানায় মানুষের মত ৫টি আঙ্গুল আছে। এদের পায়েও পাঁচটি আঙ্গুল আছে। এদের পা অবিকশিত এবং খুব দূর্বল তাই এরা মাটিতে ভালোকরে দাড়াতে পারে না। গাছের ডাল বা মাটি থেকে এরা পায়ের উপর ভর দিয়ে উড়তেও পারে না।
বিচিত্র উড়া
আপনি শুনলে অবাক হবেন যে বাদুড় সরাসরি ডানা ঝাপটে বসা অবস্থায় থেকে আকাশে উড়তে পারেনা। উপর থেকে নিচে পরার সময় ডানা মেলে দেয়।এরপর বাতাসে ভাসার সময় ডানা ঝাপটে উড়তে থাকে। পাহাড় থেকে গ্লাইডিং করার সময় মানুষ যেমন সরাসরি নেমে আসে ঠিক তেমনি।
বাদুড় নিবাস
পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে।যত স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে দুনিয়াতে তার প্রায় ২০% বাদুড় প্রজাতি।আমেরিকার টেক্সাস শহরের ব্র্যাকেন কেভ নামের গুহায় প্রায় ২ কোটি মেক্সিকান ফ্রী-টেইলড বাদুড় (Tadarida brasiliensis) বাস করে।এটি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ীদের জমায়েত।
খাদ্য
সব বাদুড় কিন্তু ফল খায়না। প্রায় ৭০ ভাগ প্রজাতি বিভিন্ন পোকা ধরে খায়, কিছু প্রজাতি ছোট ছোট প্রাণী শিকার করে খায়। একটি বাদুড় এক মিনিটে ২০০ মশা খেতে পারে।দশটি প্রজাতি রয়েছে, যারা মাছ খায়। ইঁদুর, ব্যাঙ, গিরগিটি, ছোটখাটো পাখিসহ অন্যান্য খাদ্য খায় এদের পনেরো প্রজাতির।
বাদুড়ের বাচ্চা
সদ্যজাত বাচ্চা মায়ের দুধ পান করে। বাচ্চার সামনের একটি বা দুটি দাঁত বাঁকানো হুকের মত এর সাহায্যে বাচ্চা মায়ের দেহের সাথে লেগে থাকে।
রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার বাট
এদের একটি দলের নাম Desmodontinae. এই দলের সদস্যরা মানুষের বা অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবের রক্ত পান করে। যেমনটি আমরা ভ্যাম্পায়ার মুভিতে দেখি তারা মানুষের ঘাড়ে কামড় বসিয়ে রক্তপান করে। এই বাদুড়কে বলে রক্তচোষা বাদুড় বা ভ্যাম্পায়ার বাট। প্রতিদিন প্রায় ৩০ গ্রাম রক্ত পান করে এরা বেঁচে থাকার জন্য পরপর দুইদিন রক্ত না খেলে এদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাদুড় কি চোখে দেখতে পায়?
“বাদুড় অন্ধ চোখে দেখতে পায়না তাই এরা শব্দের সাহায্য নিয়ে চলে” এই তথ্য সবার মুখে মুখে প্রচলিত।এইটা কিন্তু ভাই এক্কেবারে মিথ্যা কথা। দিনের রৌদ্রজ্জ্বল পরিবেশে এরা আপনার থেকে ২০গুণ বেশি দেখতে পারে।
এরা কিন্তু কালার ব্লাইন্ড না সব ধরণের রং বেশ ফকফকা দেখতে পায়। নিশাচর প্রাণিরা রাত্রে বেশ ভালো দেখতে পারে কিন্তু এরা নিশাচর হলেও রাতে খুব ভালো দেখতে পারে না।
এরা রাতের অন্ধকারে চলার সময় মুখ দিয়ে উচ্চ কম্পাংকের শব্দ উৎপন্ন করে।যেতে যেতে শিস দেয়ার মত খানিকটা।সেই শব্দ চলার পথে অবস্থিত কোন প্রতিবন্ধকে বাধা পেয়ে ফিরে এসে এদের কানে প্রবেশ করে।
ফিরে আসা শব্দের বিশ্লেষণ করে বাদুড় বুঝতে পারে ঠিক কি ধরণের আর কত বড় প্রতিবন্ধক তার সামনে আছে।এরপর সেটা এরিয়ে যায়।এদের মস্তিষ্ক এখানে সূক্ষ্ম কম্পিউটারের মতো কাজ করে।
কারণ সামনের বাধার দূরত্ব কত সেটা বুঝতে মুহূর্তের মধ্যে শব্দের বেগ, দূরত্ব আর সময়ের মধ্যে সঠিক অঙ্ক কষে সঠিক নিশানা ঠিক করতে হয়।
বাদুড়ের শব্দ মানুষ শুনতে পায়না কেন?
বাদুড়ের শ্রবণ ক্ষমতা শ্রাব্যতার পাল্লায় একলক্ষ হার্জ।আর আমাদের শ্রাব্যতার সীমা ২০-২০,০০০হার্জ। মানে এ সীমার হার্জের মধ্যে আমরা কোনো শব্দ শুনতে পাবো। এদের কিচিরমিচির আমরা শুনতে পাই কারণ এটা আমাদের শোনার ক্ষমতার মধ্যে আছে।
কিন্তু যখন এরা শিস দেয় তার কম্পাংঙ্ক ২০০০০ হার্জের উপরে এটা শব্দ চলাচলের অন্য চ্যানেলে যাতায়াত করে যা আমাদের কানে প্রবেশ করে না তাই শুনতে পাইনা। যদি কোনভাবে এই কম্পাংঙ্ক আমাদের কানে প্রবেশ করে তাহলে কানের পর্দা ফেটে চিরদিনের মত বধির হয়ে যাবেন।
বাদুড়ের উপকারিতা
- প্রায় ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদে পরাগায়ণের মাধ্যম বাদুড়। বিভিন্ন ধরণের সুস্বাদু ফলের ফলন বৃদ্ধির জন্য এরা নিরলসভাবে কাজ করে। পৃথিবীর অনেক উদ্ভিদের বংশ টিকে রাখার জন্য এদের অবদান অপরিসীম।
- বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে এরা মানুষের উপকার করে। এদের পতঙ্গভুক প্রজাতি ১ ঘণ্টায় প্রায় ১২০০ মশা খেয়ে মশার বংশ ধ্বংস করে।
- বিভিন্ন স্থানে বীজ ছড়িয়ে দিতে এরা বেশ দক্ষ। একটি ফলভোজী বাদুড় একরাতে প্রায় ৬০০০ বীজ ছড়িয়ে দিতে পারে।
গুয়ানো
বাদুড়ের বিষ্ঠা বা মল কে গুয়ানো বলে। এই গুয়ানো অত্যধিক জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ। উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে এটি বেশ পুষ্টিকর। একসময় বন্দুকের গান পাউডার বা বারুদ হিসেবে গুয়ানো ব্যবহার করা হতো। গুয়ানো পাথরের উপর জমা হয়ে সল্ট পিটার বা Potassium nitrate তৈরি করে।
বাদুড়ের অপকারিতা
বেশ কিছু ভাইরাস বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। ভলভোজী প্রজাতির মাধ্যমে সার্স ভাইরাস ছড়ায়। রক্তপায়ী ভ্যম্পায়ার ব্যাট জলাতঙ্ক রোগ ছড়ায়।নিপাহ (Nipah), হেন্ডরা (Hendra), মারবার্গ (Marburg), ইবোলা (Ebola) এবং শ্বাসযন্ত্রের পীড়াদায়ক রোগ (Severe Acute Respiratory Syndrome বা সার্স-কোভ-১ এবং সার্স-কোভ-২-সৃষ্টিকারী করোনা-ভাইরাস (coronavirus) এদের থেকেই ছড়িয়েছে বলে জানা যায়।
কোন প্রাণী মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে?
porifera,cnidaria,echinodermata পর্বের প্রাণী যেমন জেলিফিস,সমুদ্র শশা বা সি কিউকাম্বার মুখ দিয়ে মলত্যাগ করে।
Please Click on Just one Add to help us
মহাশয়, জ্ঞান বিতরণের মত মহৎ কাজে অংশ নিন।ওয়েবসাইট টি পরিচালনার খরচ হিসেবে আপনি কিছু অনুদান দিতে পারেন, স্পন্সর করতে পারেন, এড দিতে পারেন, নিজে না পারলে চ্যারিটি ফান্ডের বা দাতাদের জানাতে পারেন। অনুদান পাঠাতে পারেন এই নম্বরে ০১৭২৩১৬৫৪০৪ বিকাশ,নগদ,রকেট।
এই ওয়েবসাইট আমার নিজের খরচায় চালাই। এড থেকে ডোমেইন খরচই উঠেনা। আমি একা প্রচুর সময় দেই। শিক্ষক হিসেবে আমার জ্ঞান দানের ইচ্ছা থেকেই এই প্রচেষ্টা। আপনি লিখতে পারেন এই ব্লগে। এগিয়ে নিন বাংলায় ভালো কিছু শেখার প্রচেষ্টা।