মহুয়া। মহুয়া ফুল ও ফল এর ব্যবহার।

মহুয়া। মহুয়া ফুল ও ফল এর ব্যবহার।

মহুয়া ফুল শুধু সৌন্দর্য বর্ধনই করে না সাথে মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংস্থান করে। আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মহুয়া নামের উদ্ভিদ। আসুন আজ এই উদ্ভিদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

আপনি আরোও পড়তে পারেন……..

মহুয়া গাছের বৈজ্ঞানিক নাম

মহুয়া উদ্ভিদ হলো Sapotaceae পরিবারের সদস্য। মহুয়া উদ্ভদের বৈজ্ঞানিক নাম মাধুকা লঙ্গিফোলিয়া (Madhuca longifolia) বা মাধুকা ইনডিকা (Madhuca indica)। মহুয়া বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন নামে যেমন মহুল, মহুলা, মধুকা, মোহা, মোভা, মহুভা ইত্যাদি।

মহুয়া উদ্ভিদ কোথায় পাওয়া যায়?

মহুয়া মূলত পাহাড়ি এলাকার গাছ। ভারতীয় বনভূমির একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। শুকনো ও পাহারী পরিবেশে এই গাছ বেশি ভালো জন্মালে ও বেড়ে উঠলেও সমতল ভূমিতে এবং আদ্র-কোমল আবহাওয়াতেও ভালো জন্মায়। এটি ভারতের খুব পরিচিত একটি গাছ এবং আদিবাসীদের জীবনের সাথে এটি ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে আছে। আদিবাসীরা একে মিরাকেল গাছ মনে করে।

মহুয়া উদ্ভিদের উৎপত্তি হয়েছে মধ্যভারতে। মধ্যভারতে এই উদ্ভিদ বেশি হয়। ঢাকাতে কিছু মহুয়া গাছ আছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতানুসারে ঢাকার রমনা পার্কে তিনটি মহুয়া ফুলের গাছ দেখা গেছে। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি মহুয়া জোন রয়েছে যেখানে ২৫-৩০ টি গাছ।

মহুয়া গাছ এর বর্ণনা

মহুয়া গাছ লম্বায় প্রায় ৬০ ফিট লম্বা হতে পারে। মহুয়া গাছের কাঠ অনেক শক্ত। মহুয়া গাছের ছাল ধূসর রঙের এবং প্রায় আধা ইঞ্চি পুরু। পাতা ডিম্বাকার কিন্তু পাতার বৃন্ত ছোট। শীতে সব পাতা ঝরে যায়।

মহুয়া ফুল এর বর্ণনা

গাছের বয়স জখন ১০ বছর হয় তখন থেকে ফুল ফুটতে শুরু করে। ফাল্গুন মাসে অর্থাৎ বসন্তকালে ফুল ফোটে। সূর্যাস্ত্রের পর রাত বারার সাথে সাথে মহুয়ার ফুল ফোটে কিন্তু সূর্যাদয়ের পর এই ফুল ঝড়ে পরে। ঝড়ে পরা ফুলগুলো দুপুর নাগাদ সাদা রঙ ধারণ করে।  গোলাপজামের মত দেখতে সুন্দর ফুলগুলো রসালো ও টক-মিষ্টি স্বাদের এবং ফুলের নির্যাসে আছে মাদকতা।

মহুয়া ফুল

মহুয়া ফল এর বর্ণনা

বসন্তের শেষে সুপারির মতো ফল হয়। জুন থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ফল পরিপক্ব হয়। ফলগুলো মাংসল এবং প্রতিটি ফলে ১ থেকে ৪টি বাদামী রঙের বীজ থাকে। গাছের বয়সের উপর নির্ভর করে একটি গাছ ২০ কেজি থেকে ২০০ কেজি পর্যন্ত বীজ তৈরি করে।

মহুয়া ফুলের ব্যবহার

ভারতীয় উপজাতীয়রা মহুয়া ফুল খায় বিভিন্ন ভাবে। মহুয়া ফুলের পাল্প মিষ্টি ও কার্বোহাইড্রেট এর একটি উৎস। তাই এই ফুল থেকে জ্যাম, জেলি, স্কোয়াশ, এবং অন্যান্য কনফেকশনারি দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা যায়। মহুয়া ফুল দিয়ে ভারতের মহারাষ্ট্রের ট্রাইবাল কো-অপারেটিভে জ্যাম প্রস্তুত করা হয়।

খাবারকে সুগন্ধযুক্ত করতে মহুয়া ফুল রান্নায় ব্যবহার করা হয়। পাটিসাপটার মত এক ধরণের পিঠাও তৈরি হয় মহুয়া ফুল থেকে। মহুয়া ফুলের সাথে অন্যান্য জিনিস মিশিয়ে তৈরি হয় প্যান কেক। বিহারের অনেক জায়গাতে রৌদ্রে শুকানো মহুয়া ফুল গুঁড়ো করে এক ধরনের আটা তৈরি করা হয় এবং এ থেকে বিভিন্ন ধরণের রুটি প্রস্তুত করা হয়। উপজাতীয়দের যখন খাবারের অভাব হয় তখন শুকানো মহুয়া ফুল গুড় দিয়ে সেদ্ধ করে খায় এরা। শুকনো ফুল অনেকদিন রেখে দেওয়া যায়।

মহুয়া ফুলের মদ

মহুয়া ফুলের নির্যাস আদিবাসীদের প্রিয় পানীয়, বিশেষ করে সাঁওতালদের খুবই প্রিয় এই পানীয়। উপজাতীয়রা এই ফুল থেকে তাদের পদ্ধতিতে বাড়িতে এলকোহলিক ড্রিংক তৈরি করে থাকে। এই কাজটি সাধারণত মহিলারা করে থাকে। মহুয়া ফুল থেকে যে পানীয় তৈরি হয় তা খুব একটা কড়া স্বাদের হয় না যার কারণে সবাই পান করতে পারে এই পানীয়। প্রায় ৯৫% ফুল দিয়ে পানীয় প্রস্তুত করে উপজাতীয়রা।

মহুয়া ফলের ব্যবহার

মহুয়ার ফল কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থাতেই খাওয়া যায়। ফলের খোসা সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মহুয়ার ফল পশ্চিম উড়িষ্যার মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাবার। ফল রান্না করে খাওয়া হয়। ফলকে ওরা বলে কজরা। মহুয়া ফল সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক বাদুরের খুব প্রিয় খাবার এই ফল, বিশেষ করে ফ্রুট ব্যাট। এরা ১০০ কিলোমিটার উড়ে আসে জঙ্গলে এই ফল খাওয়ার জন্য।

মহুয়ার তেল এর ব্যবহার

মহুয়ার বীজ থেকে তৈরি হয় মহুয়া তেল। মহুয়ার তেলের বিশেষত্ব হলো এই তেল মানুষের ত্বককে শুষ্ক হতে দেয় না এবং স্কিন কেয়ারের জন্য খুবই উপকারী। সাবান এবং ডিটারজেন্ট তৈরিতে ব্যবহার হয় এই তেল। খাবার এবং জ্বালানী হিসেবেও এই তেল ব্যবহার করা হয়।

মহুয়া বীজ

মহুয়া বাটার

মহুয়া বীজের গুড়া ভালোভাবে রিফাইন করে মহুয়া বাটার পাওয়া যায়। এই বাটার রান্নার পাশাপাশি মোম, সাবান বা ত্বকের ক্রিম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ত্বকের শুষ্কতা রোধ করা ও রিঙ্কেল দূর করতে সহায়তা করে।

মহুয়ার ভেষজ গুণ

মহুয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ তার ভেষজ গুণের জন্য। মহুয়ার পাতা, বাকল, ফুলের নির্যাস ও বীজের তেল নানা রোগের চিকিৎসায় বহুকাল ধরে ব্যবহূত হয়ে আসছে। ঔষধি কাজে ফুল থেকে সিরাপ তৈরি করা হয়। ফুল ব্রংকাইটিস ও চক্ষু রোগের উপকারে আসে। পোড়ানো মহুয়ার পাতা ঘি এর সাথে পোড়া ক্ষতে ব্যবহার করলে খুবই উপকার পাওয়া যায়। মহুয়া গাছের ছাল ডায়াবেটিস এর জন্য খুবই উপকারী। পুরনো ক্ষত ও কীট দংশনেও ভালো উপকার পাওয়া যায়।

মহুয়া তেল চর্ম রোগের জন্য ওষুধ হিসেবে কাজ করে। কন্সটিপেশনের জন্য ল্যাক্সেক্টিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয় মহুয়ার ওষুধ। সর্দি কাশি, অগ্নিমান্দ্য, আন্ত্রিক রোগ, অর্শ, বাত-ব্যথা, মাথার ব্যথা ইত্যাদি নিরাময় হয় মহুয়া গাছের ওষুধে। গাছের ছাল লেপ্রসি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। মশার যন্ত্রণা এবং কীটপতঙ্গের দংশনের ক্ষেত্রে মহুয়া বীজের তেল ব্যবহার করে থাকে সাঁওতালেরা। ফুল কাশির জন্য ভালো এবং পুরনো ক্ষত বা বাতের ব্যাথার জন্য খুবই উপকারি। আদিবাসী মেয়েরা চুলের জন্যও এই তেল ব্যবহার করে থাকে।

মূল লেখক-

আসমা অন্বেষা

Leave a Comment