হাম রোগ কী? হাম এর কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!

হাম রোগ কী? হাম এর কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!

হাম একটি সংক্রামক রোগ। আরএনএ প্যারামিক্সো ভাইরাস (RNA paramyxo virus) -এর আক্রমণের ফলে এ রোগ হয়। শিশুদের সংক্রামক রোগের মধ্যে হামই সবচেয়ে মারাত্মক। সাধারণত দুই থেকে পাঁচবছর-বয়সী শিশুদের এ রোগ বেশি হয়। হাম অনেক সময় সাংঘাতিক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, শিশুর যদি ভিটামিন ‘এ’-র অভাব থাকে, হামে আক্রান্ত হলে পরবর্তীকালে শিশু অন্ধ হয়ে যেতে পারে । এ রোগে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুর চার মাস থেকে দুই বছর বয়সের মধ্যেই এ রোগের সংক্রমণ বেশি ঘটে থাকে। তিনমাসের কমবয়সী শিশুদের হাম সচরাচর দেখা যায় না ।

হাম রোগ কী? হাম এর কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!

আপনি আরও পড়তে পারেন …… মাম্পস রোগ কী?মাম্পস রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা!

হাম রোগের ইংরেজি কী?

হাম রোগের ইংরেজি Measles উচ্চারণ মিজল্‌স

হাম রোগের আঞ্চলিক নাম কী?

হাম রোগের আঞ্চলিক নাম লুতি বা লুতমি অনেক অঞ্চলে এই রোগ খেসরা নামেও পরিচিত।

হাম রোগের জীবাণুর নাম কী?

কোন ভাইরাসের কারণে হাম হয়? এটার উত্তর হলো মিজলস মরবিলিভাইরাস নামক ভাইরাস এর কারণে হাম রোগ হয়।এই ভাইরাসটি প্যারামক্সিভাইরাস গোত্রের মর্বিলিভাইরাস গণের অন্তর্গত একটি ভাইরাস।

হাম কি ছোঁয়াচে রোগ?

হাম ছোঁয়াচে রোগ।

হাম জ্বর কতদিন থাকে?

সচরাচর হামে আক্রান্ত রোগীর জ্বর ৩ দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। সম্পূর্ণ রোগ ভালো হতে প্রায় ৭ দিন লাগে।

হাম হলে কি গোসল করা যায়?

হ্যাঁ, হাম হলে গোসল করা উচিত কারণ গোসল না করলে চর্ম রোগ হতে পারে।

হাম কাদের বেশি হয়?

হাম শুধু শিশুদেরই নয়, বড়দেরও হতে পারে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং এর চেয়ে বেশি বয়সের মানুষেরও হাম হতে দেখা যায়। জেনে রাখা ভালো, বড়দের হাম হলে শরীরে জটিলতা বেশি হয়। বড়দের হামের কারণে যেসব জটিলতা হতে পারে তা হচ্ছে মারাত্মক নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, কানের সংক্রমণ, ইত্যাদি। এছাড়াও, অনেক সময় মস্তিষ্কের প্রদাহ হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়েদের হাম হলে গর্ভস্থ শিশুর ওজন কমে যেতে পারে।

হাম যেভাবে ছড়ায়

শিশুদের ক্ষেত্রে হামে আক্রান্ত কোনো শিশুর কাছ থেকে জীবাণুটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এবং সুস্থ শিশুর শরীরে প্রবেশ ক’রে রোগ সৃষ্টি করে। তবে, সময়মতো টিকা দেওয়া থাকলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। বড়দের ক্ষেত্রে সাধারণত আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস আশপাশের সুস্থ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির কক্ষে প্রবেশ করলেও সুস্থ যেকেউ হামের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

হাম রোগের ছবি কিভাবে হাম চিনবো?

হাম রোগের ছবি
হাম রোগের ছবি

হামের লক্ষণ ও উপসর্গ

হামের ভাইরাসের সুপ্তিকাল ১০ থেকে ১৪ দিন। অর্থাৎ সুস্থ শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করার ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ প্রকাশ পায় ।

হাম রোগির মুখে এমন সাদা ফুসকুড়ি থাকে এটা দেখে চিনতে পারবেন
  • ১.হামে আক্রান্ত হলে প্রথম এক থেকে দুই দিন জ্বর থাকতে পারে এবং তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটেরও বেশি হতে পারে
  • ২.জ্বর শুরু হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিনের মাথায় শরীরের বিভিন্ন অংশে ঘামাচির মতো লাল দানা দেখা দেয় । দানাগুলো প্রথমে কানের পেছনে এবং কপাল ও চুলের সংযোগস্থলে বেশি দেখা যায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লাল দানায় সারা শরীর ভরে যায়। হামের লাল দানা ওঠার ৪ দিন আগে থেকে শুরু করে পরবর্তী ৪ দিন পর্যন্ত রোগীর শরীর থেকে হামের জীবাণু অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারে
  • ৩.আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর ম্যাজম্যাজ করে, নাক দিয়ে পানি ঝরে এবং হাঁচি হয়
  • ৪.চোখ লাল হয়, চোখ দিয়ে পানি পড়ে এবং আলোর দিকে তাকাতে কষ্ট হয়
  • ৫.মুখের ভেতর লবণদানার মতো সাদাটে ছোট ছোট দাগ হয়। একে ‘কড়'(Koplik’s spot) সেগুলো হলো মস্তিষ্কের প্রদাহ, মুখের প্রদাহ, অন্ত্রের প্রদাহ, পেটের অসুখ, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালির প্রদাহ, চোখের কর্নিয়ার প্রদাহ, কর্নিয়াতে আলসার বা ঘা, কানের প্রদাহ, পুষ্টিহীনতা, শরীরের ওজন মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া, ইত্যাদি। গর্ভাবস্থায় মায়েদের হাম হলে গর্ভপাত ও অকাল প্রসব হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।

শিশুর মারাত্মক হামের লক্ষণ

হামের সঙ্গে যদি নিচের যেকোনো তিনটি উপসর্গ বা চিহ্ন শিশুর দেহে দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে শিশু মারাত্মক জটিল ধরনের হামে আক্রান্ত হয়েছে:

  • ১.শিশু বুকের দুধ বা পানি পান করতে পারে না যা খায় সবই বমি করে দেয় খিঁচুনি হয়।
  • ২.অজ্ঞান হয়ে যায় বা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে
  • ৩.চোখের মণিতে ঘোলাটে ভাব দেখা যায় ৪.নিউমোনিয়া হয়
  • ৫.পাতলা পায়খানা ও পানিশূন্যতা থাকে
  • ৬.শ্বাস-প্রশ্বাসে শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায়
  • ৭.মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়

বড়দের হাম হলে করণীয়

হামে আক্রান্ত রোগীকে অন্যদের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। জ্বর না কমা পর্যন্ত রোগীকে বিছানায় পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। এ সময় প্রচুর তরল ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। রোগীকে অবশ্যই সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

শিশুদের হাম হলে কি করনীয়

  • ১. তীব্র হামে আক্রান্ত শিশুকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে।
  • ২. আক্রান্ত শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি স্বাভাবিক খাবার খাওয়ানো অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। মুখে যদি ঘা থাকে তার চিকিৎসা দিতে হবে।
  • ৩. হামের সঙ্গে নিউমোনিয়া, কানপাকা, ডায়রিয়া, রক্ত আমাশয়, খিঁচুনি, মারাত্মক পানিশূন্যতা ইত্যাদি থাকলে তার চিকিৎসাও করাতে হবে।
  • ৪. হাম হলে কখনো কখনো পুরোপুরি সেরে উঠতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস লেগে যায়। এসময় আক্রান্ত শিশু বারবার অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী নিউমোনিয়া বা ডায়রিয়ার শিকার হতে পারে। তাই পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে।

শিশুর হাম রোগের চিকিৎসা ও ঔষধ

হামে আক্রান্ত শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ দিতে হবে যদি না শিশুটি এক মাসের মধ্যে প্রতিরোধক ‘এ’ ভিটামিনের ডোজ পেয়ে থাকে। জ্বর যদি ১০২ ডিগ্রির উপরে যায় এবং এতে শিশু বেশ কষ্ট পাচ্ছে বলে মনে হয়, তবে প্যারাসিটামল দিতে হবে। জ্বর যদি তিন-চার দিনের বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে আরো কোনো সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা লাগতে পারে।

মাম্পস রোগের টিকা

এমএমআর টিকা গ্রহণের মাধ্যমে হাম, রুবেলা ও মাম্পস রোগ প্রতিরোধ করা যায়। রুবেলা নিয়ে কোনো শিশু যাতে জন্ম না নেয় এবং হাম, রুবেলা ও মাম্পসে আক্রান্ত হয়ে যাতে কোনো শিশু আর মারা না যায় সেজন্য ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ থেকে সরকার বিনামূল্যে এমএমআর টিকা দিতে শুরু করেছে। এই তিনটি রোগ প্রতিরোধ করতে সকলেরই বয়স অনুযায়ী এই টিকা নেওয়া জরুরি।

হাম রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা

  • হাম রোগ হলে রোগীর জ্বর হয় তাই জ্বর কমাতে রোগীর শরীরে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দেয়া উচিত।
  • রোগী যাতে দুর্বল না হয় সেজন্য বারবার অল্প অল্প করে তরল খাবার খাওয়ানো উচিত।
  • ভিটামিন সি জাতীয় ফলমূল খেতে হবে।
  • ত্রিফলার চূর্ণ হালকা গরম পানিতে গুলে দিনে একবার করে খাওয়া উচিত।

হাম প্রতিরোধে করণীয়

চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। শিশুর বয়স ৯ মাস হলে তাকে নিকটস্থ হাসপাতাল থেকে এক ডোজ হামের টিকা দিলে সে পরবর্তীকালে হামের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে। হামে আক্রান্ত হলে সতর্ক থাকতে হয়। সতর্কতা অবলম্বন না করলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে, এমনকি শিশুর মৃত্যুও হতে পারে ।

হাম হলে কি কি খাওয়া যায় না

হাম রোগ হলে সব খাবার খেতে পারবেন। তবে শক্ত খাবার না খেয়ে বারবার অল্প অল্প করে তরল খাবার খেতে হবে। যে খাবারে এলার্জি হয় সেই খাবার না খাওয়াই ভালো। অনেকে হামে আক্রান্ত রোগীকে মাছ মাংস খেতে নিষেধ করেন এটা ঠিক নয়।এটা এক ধরণের কুসংষ্কার।

লেখক
ডা. রীনা দাস
আইসিডিডিআর,বি