ভাইরাল হেপাটাইটিস কী? হেপাটাইটিস প্রকারভেদ ও প্রতিরোধের উপায়!

ভাইরাল হেপাটাইটিস কী? হেপাটাইটিস প্রকারভেদ ও প্রতিরোধের উপায়!

ভাইরাল হেপাটাইটিস একটি সংক্রামক রোগ। নাম শুনেই বুঝা যায় এটা ভাইরাসজনিত রোগ। বিশ্বে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ মানুষ এই রোগে প্রাণ হারায়।প্রতি বছর এই লিভারের রোগের কারণে বিশ্বব্যাপী এক কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।কিছু সহজ ও স্বাধারণ বিষয় পালন ও পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

আপনি আরো পড়তে পারেন…. হেপাটাইটিস-বি কী? হেপাটাইটিস-বি লক্ষণ ও প্রতিরোধ! …… হেপাটাইটিস সি কী?হেপাটাইটিস সি লক্ষণ ও প্রতিরোধ!হেপাটাইটিস-ই কী! হেপাটাইটিস-ই কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ!হেপাটাইটিস এ কী? হেপাটাইটিস এ লক্ষণ ও প্রতিরোধ! .

ভাইরাল হেপাটাইটিস কী?হেপাটাইটিস প্রকারভেদ ও প্রতিরোধের উপায়!

জন্ডিস ও হেপাটাইটিস এর পার্থক্য কী?

কেউ ভাইরাল হেপাটাইটিস এ আক্রান্ত হলে সাধারণত লোকে বলে জন্ডিস হয়েছে। এ-কথাটা ঠিক নয়। আসলে জন্ডিস রোগের নাম নয়, রোগের লক্ষণ। ভাইরাল হেপাটাইটিস রোগ হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জন্ডিস (চোখ হলদে হয়ে যাওয়ার লক্ষণ) দেখা যায়। জন্ডিস ছাড়াও ভাইরাল হেপাটাইটিস হতে পারে, কারণ রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যখন ২ মিঃ গ্রাঃ (৩৪ মাইক্রোমোল লিঃ) বা তার বেশি হয় কেবল তখন জন্ডিস (চোখ-হলদে) বুঝা যায়।

ভাইরাল হেপাটাইটিস এর প্রকারভেদ

হেপাটাইটিস এর প্রকারভেদ

ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রধাণত ৫ প্রকার
হেপাটাইটিস-এ, বি, সি, ডি, ই।

কোন হেপাটাইটিস বেশি মারাত্মক

সংক্রমণের দিক থেকে হেপাটাইটিস-এ, বি, সি, ডি, ই মধ্যে হেপাটাইটিস-বি সবচেয়ে মারাত্মক।’বি’ এর আক্রমণ হার বেশি।গর্ভবতী মহিলা ‘বি’ তে আক্রান্ত হলে গর্ভস্থ শিশুও এই রোগের দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে। রোগের তীব্রতার ভিত্তিতে হেপাটাইটিস ‘সি’ বেশি মারাত্মক।তবে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই, কেননা এ-রোগের চিকিৎসা আছে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

হেপাটাইটিস কী ছোঁয়াচে?

না, হেপাটাইটিস ছোঁয়াচে নয় তবে মারাত্মক সংক্রামক। পৃথিবীতে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পরছে। এটা মানবজাতির জন্য একটি ভয়ঙ্কর ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। মনেকরা হচ্ছে ভবিষ্যতে এই রোগের কারণে পৃথিবীর জনসংখ্যা অনেক হ্রাস পাবে।

হেপাটাইটিস এর কারণ

হেপাটাইটিস-এ, বি, সি, ডি, ই ইত্যাদি ভাইরাস সংক্রমণের মাধ্যমে এ রোগ হয় এবং সে অনুসারে এ রোগের নামকরণ করা হয়।

হেপাটাইটিস ভাইরাস কীভাবে শরীরে প্রবেশ করে

হেপাটাইটিস ভাইরাস এর নামযেভাবে শরীরে প্রবেশ করে
হেপাটাইটিস-এমুখ দিয়ে দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে পানি এবং খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে।
হেপাটাইটিস-বিজীবাণু-সংক্রমিত সিরিজ, সূচ, ক্ষুর, ব্লেড, চাকু, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি ব্যবহার (বিশেষ করে দাঁতের), রক্ত পরিসঞ্চালন,অনিরাপদ যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে।
হেপাটাইটিস-সিরক্ত আদান প্রদানের মাধ্যমে,জীবাণু-যুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম বব্যবহারের মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি এর সংক্রমণ হয়।
হেপাটাইটিস-ডিরক্ত গ্রহন করার সসময় জীবাণুযুক্ত রক্ত গ্রহণ করা,সংক্রামিত ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ব্যবহার,একই সিরিঞ্জ দিয়ে অনেকজন মাদক নেয়া, শেভিংয়ের সময় অনেক জনের ব্যবহৃত ক্ষুর ও কাঁচি ব্যবহারের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।
হেপাটাইটিস-ইমুখ দিয়ে দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে পানি এবং খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে।
ভাইরাল হেপাটাইটিস কিভাবে সংক্রমন করে?
ভাইরাল হেপাটাইটিস কিভাবে সংক্রমন করে

হেপাটাইটিস এর লক্ষণ

বিভিন্ন হেপাটাইটিস এর বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ আছে।

হেপাটাইটিস এর নামহেপাটাইটিস এর লক্ষণ
হেপাটাইটিস -এলিভার ফুলে যাওয়া, ক্ষিদে কমে যাওয়া, জ্বর, বমি এবং জয়েন্টে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।
হেপাটাইটিস -বিবেশিরভাগ সময় বমি বমি ভাব হয়,রোগী পেটে ক্ষুধা থাকলেও ক্ষেতে চায় না,রোগীর শরীরে ক্লান্তিভাব সবসময় থাকে, কোলিক, ত্বক ও চোখ হলুদ হয়।দেখে মনে হয় স্বাধারণ জন্ডিস রোগী। এটি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগ যা লিভার সিরোসিস এবং ক্যান্সারের রূপ নেয়।
হেপাটাইটিস -সিতেমন কোন লক্ষণ প্রাথমিক আক্রমণে দেখা যায় না।রোগীর দেহে অনেক দিন ধরে এই রোগের জীবাণু থাকলে লিভারে ক্ষত এবং বেশ কয়েক বছর পর সিরোসিস সৃষ্টি করে।সিরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার ফেইল হয়। অনেকের লিভারের ক্যান্সার সৃষ্টি হয়, খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর শিরা ফুলে উঠতে পারে এতে করে পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
হেপাটাইটিস -ডিযাদের হেপাটাইটিস -বি আক্রমণ করেছে তাদের এ রোগ হয় অর্থাৎ ‘বি’ ও ‘সি’ একসাথে আক্রমণ করে।’বি’ এর উপসর্গের পাশাপাশি লিভারের সংক্রমণের ফলে বমি ও হালকা জ্বর হয়।
হেপাটাইটিস -ইরোগীর শরীরে ক্লান্তিভাব সবসময় থাকে, ওজন কমে যায়, ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়,বেশিরভাগ সময় জ্বর থাকে।
হেপাটাইটিস এর লক্ষণ
হেপাটাইটিস এর লক্ষণ

কিছু সাধারন লক্ষণ

  • পেশী এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা
  • উচ্চ তাপমাত্রা
  • অসুস্থ অনুভব করা
  • সব সময় অস্বাভাবিকভাবে ক্লান্তি
  • ক্ষুধামান্দ্য বা অরুচি
  • পেটে ব্যথা
  • গাঢ় প্রস্রাব
  • ফ্যাকাশে, ধূসর রঙের মল
  • ত্বকে চুলকানি
  • জন্ডিস

হেপাটাইটিস এর চিকিৎসা

হেপাটাইটিস A ভালো করার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। হেপাটাইটিস A লিভারের বেশি ক্ষতি না করলে ৬ মাসের মধ্যে লিভার নিজেই নিজের স্বাস্থ্য ঠিক তরে নেয়।

হেপাটাইটিস-বি ও সি টিকা নেয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়াও এন্টিভাইরাল ঔষধ সেবনের মাধ্যমে এটার চিকিৎসা করা হয়।হেপাটাইটিস-B এর ভ্যাকসিন ডোজ ৪টি। প্রথম ৩টি একমাস পরপর এবং ৪র্থটি প্রথম ডোজ থেকে এক বছর পর দিতে হয়। পাঁচ বছর পর বুস্টার ডোজ নিতে হয়।

ভাইরাল হেপাটাইটিস প্রতিরোধের উপায়

  • ভাইরাল হেপাটাইটিসের টিকা নেবেন। সর্বদা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবেন এবং পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখবেন। খাদ্যদ্রব্য সবর্দা ঢেকে রাখবেন।
  • রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হলে, সেই রক্ত হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসমুক্ত কি না তা অবশ্যই পরীক্ষা করিয়ে নেবেন। ভাইরাল হেপাটাইটিস সন্দেহ হলে সংগে সংগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
  • ইনজেকশনের প্রয়োজন হলে একবার ব্যবহারযোগ্য (Disposable) সূঁচ এবং সিরিঞ্জ ব্যবহার করবেন।
  • নাপিতের দোকানে গেলে নতুন ব্লেড ব্যবহার করছে কিনা তা দেখে নেবেন। দাঁতের চিকিৎসকের যন্ত্রপাতি ঠিকমত জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবে দাঁতের অস্ত্রোপচার করাবেন।
  • যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলবেন।

হেপাটাইটিস প্রতিরোধে যা করবেন না

হাজামের কাছে বাচ্চাদের খতনা করাবেন না।
ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহার্য জিনিষপত্র অন্য কেউ
ব্যবহার করবেন না। মাদকদ্রব্য ব্যবহার করবেন না।
অবাধ যৌনাচার করবেন না।

হেপাটাইটিস প্রতিরোধে যা খাবেন

পানি ২০ মিনিট ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করবেন (টিউবওয়েলের পানি
ফুটানোর প্রয়োজন নেই)।
ফলমূল, সালাদের উপকরণসমূহ, ভাল করে ফুটানো পানিতে ধুয়ে নেবেন।

হেপাটাইটিস প্রতিরোধে যা খাবেন না।

পুকুরের বা নদীর পানি।
বাহিরের খোলা, বাসি খাবার। ভাইরাল হেপাটাইটিসের রোগীদের জ্ঞাতব্য

ভাইরাল হেপাটাইটিস হলে কি করা উচিত

চিকিৎসকের পরামর্শমত বিশ্রামে থাকবেন— যতদিন আপনার চিকিৎসক থাকতে বলেন।
যতদূর সম্ভব পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে আলাদা থাকবেন।
সম্ভব হলে পৃথক টয়লেট ব্যবহার করবেন।
হেপাটাইটিস-বি হলে স্ত্রীসহবাসের সময় অবশ্যই ‘কনডম’ ব্যবহার করবেন।
সুস্থ হবার পর প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শমত টিকা নেবেন।
মনকে সর্বদা প্রফুল্ল রাখবেন। মনের সাহস হারাবেন না।
আপনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন—এ বিশ্বাস সর্বদাই রাখবেন।

ভাইরাল হেপাটাইটিস আক্রান্ত হলে যা করবেন না

সুস্থ হওয়ার পর অন্তত ৩ মাস পর্যন্ত শক্ত পরিশ্রমের কাজ করবেন না। ঝাড়-ফুঁক, মালা পড়া, হাত-ধোয়া, ইত্যাদি করবেন না, কারণ এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। হাতুড়ে ডাক্তার বা কবিরাজের চিকিৎসা করাবেন না।
যা যা খাবেন স্বাভাবিক খাবার খাবেন। রোগ মারাত্মক পর্যায়ে গেলে যা খাওয়া নিষেধ।
তা আপনার চিকিৎসক বলে দেবেন। হলুদ, মরিচ, পিঁয়াজ, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, দুধ, শাক-সব্জি,ফলমূল সব খেতে পারবেন। চিকিৎসকের পরামর্শমত ঔষধ খাবেন।

ভাইরাল হেপাটাইটিস হলে কি খাবেন না

  • পাতে আলগা লবণ ।
  • বিভিন্ন গাছের পাতার রস।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত স্যালাইন নেবেন না।
  • গ্লুকোজ, আখের রস, জাম্বুরার রস, ইত্যাদি খেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই—বরং বেশি খেলে পেটে গ্যাস হয় এবং খাবারে অরুচি বাড়ে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খাদ্য প্রস্তুত করা না হলে ক্ষতির কারণ হতে পারে।

লেখক-ডাঃ এম. মতিউর রহমান
আইসিডিডিআর,বি

Please Click On Just One Add To Help Us