এলার্জিক রাইনাইটিস কী?ঘনঘন হাঁচি আসে ও ঠাণ্ডা লাগে কেন?

এলার্জিক রাইনাইটিস কী?ঘনঘন হাঁচি আসে ও ঠাণ্ডা লাগে কেন?

মিসেস মায়া একজন বিসিএস কর্মকর্তা। শীতের সকালে ঘুম থেকে ওঠেন বিষন্ন মনে মাথাব্যথা আছে ও মাথায় কী যেন চাপ দিয়ে ধরে আছে এমন মনে হয় তাঁর কাছে। বার বার হাঁচি আসে এবং একবার শুরু হলে বেশ কিছুক্ষণ চলতে থকে।

নাক দিয়ে অবিরত পানি করে এবং নাক ও চোখ চুলকায়। ঘুমের সময় তাঁর মুখ শুকিয়ে যায়। ঘুম থেকে ওঠার পর নাকের পিছনে অথবা গলায় অল্প কাশি জমে থাকে। এর সাথে কান ভার ভার লাগে এবং নিজের মুখের কথা কানে বাজে।

সারাদিন ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে তাঁকে অফিস করতে হয়। অফিসের কাজে সঠিক মনোনিবেশ করতে পারেন না। সহকর্মীনের সামনে তাঁর এ-অবস্থার জন্য তাঁকে প্রায়ই বিব্রত হতে হয়। আসলে তিনি একটি রোগে ভুগছেন যাকে বলা হয় ‘এলার্জি রাইনাইটিস’। ঠাণ্ডাজনিত এলার্জি থেকে তাঁর এ উপসর্গগুলি সৃষ্টি হয়েছে।

এলার্জিক রাইনাইটিস কী- এলার্জিক রাইনাইটিস এর কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়

উন্নত, উন্নয়নশীল, অথবা অনুন্নত কোনো দেশই এ রোগের বিস্তার থেকে মুক্ত নয়। এ রোগে যিনি আক্রান্ত হন তিনি যেমন কাজেকর্মে সঠিক মনোযোগ দিতে পারেন না, তেমনি উপসর্গের কারণে আশপাশের লোকজন বিরক্ত বোধ করেন। শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হলে ক্লাসে মনোযোগী হতে পারে না এবং লেখাপড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।

আপনি আরও পড়তে পারেন … শিশুর ফুসফুসের রোগ ও তার প্রতিকার! …… হাঁপানি বা অ্যাজমা কী?ব্রংকিয়াল অ্যাজমার কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা! …… ইনহেলার ব্যবহার এর নিয়ম!নেবুলাইজার ব্যবহার!

এলার্জিক রাইনাইটিস কী?

এলার্জিক রাইনাইটিস (allergic rhinitis) এক ধরনের নাসিকা-ঝিল্লির(nasal mucosa) প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে।
এ রোগের সাথে আইজি-জি (IgG) অ্যান্টিবডির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এছাড়া, এ রোগের সাথে চোখের এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস এবং শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ অ্যাজমাও থাকতে পারে।

ঘনঘন হাঁচি আসে ও ঠাণ্ডা লাগে কেন?

লার্জিক রাইনাইটিস এর কারণে নাসিকা ঝিল্লির প্রদাহ হয় তাই ঘনঘন হাঁচি আসে ও ঠাণ্ডা লাগে।

এলার্জিক রাইনাইটিস কাদের বেশি হয়

বয়স, লিঙ্গ ও অঞ্চলভেদে এ রোগে আক্রান্ত লোকের শতকরা হার ১০ থেকে ২০। এ-রোগের বিস্তৃতি পুরুষের মধ্যেই বেশি। ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশেও এধরনের রোগীর সংখ্যা মোটেই কম নয়।

এলার্জিক রাইনাইটিসের প্রকারভেদ

এলার্জিক রাইনাইটিস রোগকে মূলত তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে:

প্রকারভেদবর্ণনা
১. পেরিনিয়াল (perini al)যেসব রোগী সারাবছর এ রোগে ভোগেন;
২. সিজনাল (seasonal)যারা ঋতু পরিবর্তন, যেমন গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে এ রোগে ভোগেন;
৩. পেশাভিত্তিক (occupation al)এধরনের অসুস্থতা সাধারণত পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হতে পারে, যেমন কৃষিকাজের সময় কিংবা রংশিল্পে কাজ করার সময় কেউ এ-অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারেন।
মিশ্রকখনো কখনো প্রথম দু’টি অবস্থার সংমিশ্রণ হতে দেখা যায় অর্থাৎ পেরিনিয়াল রাইনাইটিস রোগীদেরও ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে রোগের উপসর্গের তীব্রতা মাত্রাতিরিক্ত হতে পারে।

এলার্জিক রাইনাইটিসের কারণ

এলার্জিক রাইনাইটিসের কারণ

কী কী বিষয়ের সাথে এলার্জিক রাইনাইটিসের সম্পৃক্ততা রয়েছে তা আমাদের জানা খুবই জরুরী। এগুলো হতে পারে :

  • ১. ক্ষুদ্র কীট, পোকামাকড়, গৃহপালিত পশু এবং এদের মল (বিশেষভাবে উল্লেখ্য ইঁদুরের মল)
  • ২. ফুলের রেণু
  • ৩. ছত্রাকজাতীয় পদার্থ
  • ৪. শিল্পাঞ্চল ও শহরের কালো ধোঁয়া, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, ওজোন, প্রভৃতি গ্যাস থেকে এ-রোগের সৃষ্টি হতে পারে
  • ৫. ব্যথা নিবারণের জন্য ব্যবহৃত এসপিরিন (as – pirin) ও অন্যান্য এনএসএআইডি (NSAIDs) থেকে এলার্জিক রাইনাইটিস হতে পারে। এছাড়া, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহৃত কিছু কিছু ওষুধ সেবনে এ-রোগ হতে পারে
  • ৬. বাবা অথবা মা কিংবা উভয়ের এলার্জিক রাই নাইটিস থাকলে তা সন্তানের মধ্যে যথাক্রমে শতকরা ২৯ ভাগ ও ৪৭ ভাগ ক্ষেত্রে সংক্রামিত হতে দেখা যায়। যেকোনো বয়সের মানুষ, এমনকি ৬ মাসের বাচ্চাও, এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বেশিরভাগই আক্রান্ত হন ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে।

এলার্জিক রাইনাইটিস রোগের লক্ষণ

এলার্জিক রাইনাইটিস রোগের লক্ষণ
  • নাকের সিজনাল এলার্জির ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে হাঁচি হয়।
  • একবার শুরু হলে ১০ থেকে ২০টি হাঁচি হতে পারে।
  • হাঁচির সাথে নাক বন্ধ হয়ে-যাওয়া।
  • নাক দিয়ে পানি ঝরা এবং নাকের ভিতর চুলকানো প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়।
  • এর পাশাপাশি চোখ চুলকানো, গলা চুলকানো, প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। কখনো কখনো শ্বাসকষ্টও হতে পারে। তবে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে রোগের লক্ষণগুলোর তীব্রতাও পরিবর্তিত হয়।

নাকের পেরিনিয়াল এলার্জির ক্ষেত্রে লক্ষণের তীব্রতা এত বেশি নয়।নিম্নের লক্ষণগুলো দেখা যায়-

  • প্রায়ই ঠাণ্ডা লাগা।
  • নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • নাকে গন্ধ ঠিকমত না-পাওয়া।
  • গলায় সামান্য সাদাটে কাশি জমে থাকা। প্রায়ই কাশি থাকা।
  • কান ভার ভার লাগা কিংবা কানে কম শোনার লক্ষণ থাকতে পারে।
  • এছাড়া চোখের পাতা (eyelid) ফুলে যেতে পারে।
  • কখনো কখনো গলার স্বরেও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

এলার্জিক রাইনাইটিস থেকে বাঁচার উপায়

  • এলার্জিক রাইনাইটিসের সঠিক কারণ নির্ণয় করতে না-পারলে তা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। তবে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ থাকা যায়।যেমন-
  • ১.যে-কারণে এলার্জি হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাতে হবে, যেমন কারো ফুলের রেণু থেকে এলার্জি হতে পারে অথবা বিশেষ কোনো খাবার থেকেও হতে পারে।এ ক্ষেত্রে সেই নির্দিষ্ট ফুলের রেণু নাকের কাছে নেওয়া যাবে না অথবা সেধরনের খাবার বর্জন করতে হবে।
  • ২.বায়ুদূষণের কারণে এলার্জি হলে নাকে-মুখে মাস্ক পড়তে হবে এবং এধরনের বায়ুদূষণ বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এধরনের রোগীদের ঘর ঝাড়ু দেওয়া অথবা ঘরের ঝুল পরিষ্কার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ কারো পেশা হয়ে থাকলে তা পরিবর্তন করতে হবে।
  • ৩.আমরা সাধারণত দৈনিক ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রায় ১৮ ঘণ্টা থেকে ২০ ঘণ্টা ঘরের ভিতর অবস্থান করি। এজন্য, যে-ঘরে আমরা অবস্থান করি সেটি যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
  • ৪.শোবার ঘরে সারাদিন যে-চাদর বিছানো থাকে তা রাতে শুতে যাওয়ার সময় পরিবর্তন করে পরিষ্কার চাদর বিছিয়ে নিতে হবে।

এলার্জিক রাইনাইটিসের ঔষধ

ওষুধ ব্যবহার করে এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন এ-নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তবে ওষুধের সঠিক ব্যবহারের ফলে এ রোগের লক্ষণ থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পাওয়া যায়। ওসুধ মুখে খাওয়া যেতে পারে কিংবা স্থানীয়ভাবে নাকের ভিতর ব্যবহার করা যেতে পারে।

এলার্জিক রাইনাইটিসের ট্যাবলেট

মুখে খাওয়ার ওষুধগুলোর মধ্যে রয়েছে কিটোটিফেন (ketotifen),সেটিরিজিন (cetirizine), লরাটিডিন (loratidine), প্রভৃতি।

এলার্জিক রাইনাইটিসের নাকের স্প্রে

স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য স্টেরয়েডজাতীয় নাকের স্প্রে রয়েছে। এছাড়া, সাময়িক ব্যবহারের জন্য জাইলোমেটাজলিন নাকের ড্রপও রয়েছে। অবশ্য এধরনের ড্রপ একাধারে ২ সপ্তাহের বেশি ব্যবহার না করাই ভালো।

এলার্জিক রাইনাইটিস হলে কি খাবেন না

আমাদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি রয়েছে যে, এলার্জি হতে পারে এমন খাবার, যেমন ডিম, বেগুন, গরুর মাংস, চিংড়ি মাছ ও ইলিশ মাছ, খেলেই এলার্জি হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সব খাবারই সবার জন্য এলার্জি তৈরি করে না, যেমন কারো ইলিশ মাছ খেলে এলার্জি হয়, আবার কারো গরুর মাংস খেলে এলার্জি হয়। এক্ষেত্রে যার যে-খাবার থেকে এলার্জি হয় তাকে শুধু সেই খাবারই বর্জন করা উচিত।

এলার্জিক রাইনাইটিসের জটিলতা

এলার্জিক রাইনাইটিস শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। এর ফলে সামাজিক সমস্যাও তৈরি হয়। কখনো কখনো নাক থেকে কানের প্রদাহের সৃষ্টি হয়, যা থেকে রোগী পরবর্তীকালে কানে কম শুনতে পারে। এধরনের রোগীদের সাইনোসাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা দুই-তিন গুণ বেড়ে যায়। কখনো কখনো এলার্জিক রাইনাইটিসের সাথে ব্রংকিয়াল অ্যাজমা থাকতে দেখা যায়। নাক বন্ধ থাকার জন্য ফুসফুসজনিত উচ্চ রক্তচাপ (pulmonary hypertension) হতে পারে। তাই অবহেলা না করে এলার্জিক রাইনাইটিসের সঠিক কারণ নির্ণয় ও চিকিৎসার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক
সাবাহ উদ্দিন আহমেদ,
মুহ: শামীম বিন সাঈদ খান,
এম শাহাদাত হোসেন
আইসিডিডিআর,বি