কান পাকা রোগ! লক্ষণ ও প্রতিকার!
শেকড়ের বয়স চার বছর। তার মা চাকুরিজীবী একজন ব্যস্ত মহিলা। এখন থেকে আড়াই বছর আগে শেকড়ের বাম কানে প্রচন্ড ব্যথার সঙ্গে জ্বর হয়েছিলো। দুই-তিন দিনের মাথায় হঠাৎ তার বা কান দিয়ে পুঁজ পড়া শুরু হলো। সেই সাথে তার কানের বাধা কমে গেলো এবং জ্বরও চলে গেলো।
আপনি আরো পড়তে পারেন….. ব্লাক ফাঙ্গাস রোগ কী? ব্লাক ফাঙ্গাস রোগের লক্ষণ কী? … চোখের অঞ্জনি কী?চোখে অঞ্জনি হওয়ার কারণ ও প্রতিকার!
অল্প কিছু অসুধ সেবন করার ফলে সে অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলো। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করছিলো ভবিষ্যতের এক বিরাট কষ্ট। তা হলো এর কান দিয়ে পুঁজ-পড়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয় নি এবং বাম কানে কিছুটা কম শুনতে লাগলো।
আসলে কী ঘটেছিলো এর কানে।সে প্রায়ই রাতে ঘুমের মধ্যে মায়ের দুধ খেতো। খেতে খেতে যখন ঘুমিয়ে পড়তো তখন সম্ভবত অপরিচ্ছন্নতার কারণে জীবাণু দ্বারা দূষিত কিছু মুখ গলার ভিতর থেকে মধ্যকর্ণের সংযোগকারী নল (auditory tube)-এর মাধ্যমে ঢুকে পড়তো।
এতে তার মধ্যকর্ণে প্রদাহের সৃষ্টি হয়ে সংযোগকারী নল সম্ভবত বন্ধ হয়ে যেতো। মায়ের দুধ শিশুর জন্য উৎকৃষ্ট দানা, কিন্তু যথাযথ নিয়মে তা খাওয়াতে হবে।
মধ্যকর্ণের প্রদাহের ফলে উৎপাদিত পুঁজ উচ্চ চাপে পর্দা ফুটো ক’রে কানের বাইরে সম্ভবত বের হয়ে আসতো।
অপর্যাপ্ত চিকিৎসার ফলে তার ফুটো পর্দা দিনে দিনে বড় হচ্ছিলো এবং তার কষ্ট বেড়েই চলছিলো।
কান পাকা রোগ এর কারণ
মধ্যকর্ণের প্রদাহ হলো কান পাকা রোগের প্রধান কারণ।অপরিষ্কার ও জীবাণু দ্বারা দুষিত যন্ত্রপাতি দিয়ে কান পরিষ্কার করার কারণে কানের নানারূপ জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। কান পাকা রোগের জন্য ধনুষ্টংকারও হতে পারে।
মধ্যকর্ণের প্রদাহ কী?
মধ্যকর্ণের ভেতর বিভিন্ন ভাইরাস, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ফলে এখানে ক্ষত ও পুঁজ সৃষ্টি হয় একে মধ্যকর্ণের প্রদাহ বলে।
Wikipedia
বাংলাদেশসহ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বধিরতার একটা অন্যতম কারণ মধ্যকর্ণের প্রদাহ। অপর্যাপ্ত ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে এবং সেই সাথে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য-সচেতনতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে মধ্যকর্ণের স্বল্প মেয়াদী প্রদাহ দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহে পরিণত হয়েছে।
মধ্যকর্ণের দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহের প্রধান প্রধান কারণ
- বার বার শ্বাসযন্ত্রের উপরের অংশে যেমন নাকের ভিতর, গলার পিছনের অংশে সংক্রমণ ও প্রদাহের সৃষ্টি-হওয়া সাইনোসাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়া।
- নাকের ভিতর এলার্জি (allergic rhinitis) হওয়া।
- শিশুদের নাকের পিছনের দিকে অবস্থিত অ্যাডেনোয়েড (adenoid) গ্রন্থিটি বড়-হওয়া টনসিলে বার বার সংক্রমণ ঘটা।
- পুকুর, নদী-নালা ও খাল-বিলের দূষিত পানিতে গোসল করা।
- দূষিত পদার্থ দিয়ে কান-খোঁচানো
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (immunity) কম থাকা কিংবা ধীরে ধীরে কমে যাওয়া।
- ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য-সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে অজ্ঞতা।
কান পাকা রোগ এর লক্ষণ বা উপসর্গ
- কান দিয়ে পুঁজ বা পুঁজজাতীয় তরল পদার্থ বার বার বের হয়ে আসা ধীরে ধীরে কানে কম শুনা।
- কী পরিমাণ কম শুনবে তা নির্ভর করে পর্দায় ফুটোর অবস্থান ও আকারের ওপর
- ব্যথা সাধারণত থাকে না।
- তবে বার বার প্রদাহের ফলে কিছুটা ব্যথা অনুভূত হতে পারে ।
- উপরোক্ত উপসর্গসম্পন্ন রোগীকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করা হলে তার নাকের ভিতর সাইনাসে কিংবা টনসিল ও অ্যাডেনোয়েড (adenoid) গ্রন্থিতে প্রদাহ ও সংক্রমণের লক্ষণ পাওয়া যেতে পারে।
যেসব উপসর্গ ও লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হলো তা সাধারণত নিরাপদ প্রকৃতির (CSOM – safe variety) মধ্যকর্ণের প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে।
তবে কানের দীর্ঘ-মেয়াদী প্রদাহ সব সময় নিরাপদ নয়। মাঝে মাঝে বিপজ্জনক (CSOM – unsafe variety) প্রকৃতির কানের প্রদাহেও রোগীরা আক্রান্ত হতে পারে।আরো অনেক উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে।
সেক্ষেত্রে নিম্নের লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পায় যেমন-
- মাথা ঘোরানো
- মুখণ্ডল বাঁকা-হওয়া
- বহিঃকর্ণের বা মস্তিস্কের ভিতর ফোঁড়া
কানের ইনফেকশনের লক্ষণ
কান পাকা রোগ এর চিকিৎসা
নিরাপদ প্রকৃতির কানের প্রদাহের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার তা হলো:
কান পাকলে কি করতে হবে?
- কান পরিষ্কার রাখতে হবে।এর জন্য জীবাণুমুক্ত তুলা ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে।
- অ্যান্টিবায়োটিকজাতীয় অষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে।
- এক্ষেত্রে কানের পুঁজে যেধরনের জীবাণু থাকে শুধুমাত্র তার ওপর কার্যকর অষুধ ব্যবহার করলে যথোপযুক্ত ফল পাওয়া যেতে পারে। পুঁজের কালচার (culture) এবং অষুধের সেন্সিটিভিটি (sensitivity) পরীক্ষারও প্রয়োজন হতে পারে।
কান পাকা রোগ এর ঔষধ
কান পাকা রোগ ভাল করার জন্য বিভিন্ন রকমের ঔষধ আছে।
কান পাকা রোগের অ্যান্টিবায়োটিক অষুধ
কান পাকা রোগের চিকিৎসায় সবচেয়ে ভাল ৩ টি অ্যান্টিবায়োটিক অষুধ হলো-
- Lomefloxacin- প্রতিদিন একটা করে ট্যাবলেট খাবার পর খেতে হবে ৭ দিন।
- Roxitromycin 150/300mg-প্রতিদিন একটা করে ট্যাবলেট খাবার পর খেতে হবে ৭ দিন।
- Cefaclor 250/500mg প্রতিদিন ৩ বার ১ টা করে ট্যাবলেট খাবার পর খেতে হবে ৭ দিন।
কান পাকা রোগের ড্রপ
অ্যান্টিবায়োটিক অষুধ সেবনের পাশাপাশি কানের উন্নত মানের ড্রপ, যেমন Polycort, Otosporin, Genticyn HC — এসব ব্যবহার করতে হবে। কানের ড্রপ ৩ থেকে ৫ ফোঁটা দিনে ৩ বার ২ থেকে ৩ সপ্তাহের অধিক সময় লাগানোর প্রয়োজন হতে পারে।
কানের পুঁজ এর ওষুধ
কানের মধ্যে পুঁজ হলে CLOXACILLIN জাতীয় ঔষধ খেতে পারেন।CLOXACILLIN জাতীয় ঔষধের ব্র্যান্ড হলো-
ঔষধের নাম | খাওয়ার নিয়ম |
A-clox-500mg | ১+১+১+১ (ভরা পেটে) ৭/১৪ দিন খাবেন। ৬ ঘন্টা পরপর খাবেন। |
Fluclox-500mg | ১+১+১+১ (ভরা পেটে) ৭/১৪ দিন খাবেন। ৬ ঘন্টা পরপর খাবেন। |
কান পাকা রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
চিকিৎসার উপকরণ | কিভাবে ব্যাবহার করবেন |
ছেঁক দিন | নরম ত্যানা উষ্ণ জলে ডুবিয়ে কানের লতির উল্টো পাশে ধরুন তাহলে তাপের প্রভাবে কানের পুঁজ বের হয়ে আসবে।পুঁজ বের করার জন্য কান কাত করতে হবে। |
রান্নার সিরকা বা ভিনেগার | ৪ ভাগের ১ ভাগ আবসলিউট এলকোহল এর সাথে সিরকা ভালভাবে মিশিয়ে ড্রপ দিয়ে ৩-৪ ফোটা কানে দিবেন।জীবাণু মরে যাবে। |
তেলে সিদ্ধ রসুন | ৩-৪ কোয়া রসুন সরিষার তেলে গরম করে সেই তেল কয়েক ফোঁটা কানের ছিদ্রে দিবেন।কানের পুঁজ বের হয়ে আসবে। |
পেঁয়াজের রস | পেঁয়াজের রস কয়েক মিনিট গরম করুন সেখান থেকে কয়েক ফোঁটা কানের ছিদ্রে দিবেন।কানের পুঁজ বের হয়ে আসবে। |
পুদিনার পাতার রস | পুদিনার পাতার রস বের করে দুই-তিন ফোঁটা রস কানে দিন। |
হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড | ৩% হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ড্রপ দিয়ে ৩-৪ ফোটা কানে দিবেন।জীবাণু মরে যাবে।পুঁজ আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে। |
কান পাকা রোগ এর প্রতিকার ও প্রতিরোধ
- কোনো অবস্থাতেই কানের ভিতর দুধ, পানি বা ময়লা ঢুকতে পারে এমন অবস্থাকে রোধ করতে হবে।
- প্রয়োজনে সরিষার বা নারিকেল তেলে তুলা ভিজিয়ে কানে গুঁজে দিয়ে গোসল করতে হবে।
- কখনোই ডুব দিয়ে গোসল করা কিংবা সাঁতার কাটা যাবে না।
- অল্প পানিতে সাঁতার কাটলেও কান পাকা রোগী ডুবে মরে যেতে পারে, কারণ শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি বা কম তাপমাত্রায় পানি কানের ভিতর ঢুকলে মাথা ঘোরানো রোগ হয়ে পানিতে ডুবে যেতে পারে।
- অপরিষ্কার ও জীবাণু-দূষিত তুলা বা যন্ত্র দিয়ে কান পরিষ্কার করা যাবে না।
- টিটেনাস টিকার কোর্স অসম্পূর্ণ থাকলে তা সম্পন্ন করতে হবে।
- রোগীর পুষ্টিহীনতা দূর করতে হবে।
লেখক
মুহ: শামীম বিন সাঈদ খান
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।
মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন আইসিডিডিআর,বি