কিডনি রোগ এর কারণ ও প্রতিরোধ! কিডনি সুস্ব্য রাখার উপায়!
পৃথিবীর অন্যতম ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ । ছোট্ট এই দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। উন্নয়নশীল এই দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী হাজারো সমস্যার সম্মুখীন—যার মধ্যে স্বাস্থ্য সমস্যা অন্যতম । এসব স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের অসুস্থতা একটি বেশ গুরুতর সমস্যা।
আপনি আরও পড়তে পারেন … মেডুলারি স্পঞ্জ কিডনি লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধ! …… শিশুর ফুসফুসের রোগ ও তার প্রতিকার!
কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতন হবেন কেন?
কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের অন্যতম কাজ হচ্ছে আমাদের শরীরের পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষা করা, শরীরে সৃষ্ট বর্জ্য পদার্থ নিঃসরণে ভূমিকা রাখা আর সামান্য মাত্রায় হলেও সুস্থ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কিছু হরমোন তৈরি করা। অন্যদিকে, কিডনি ও মূত্রতন্ত্র যদি যথাযথভাবে কাজ করতে না পারে তবে কেবলমাত্র স্বভাবিক জীবনযাপনই বাধাগ্রস্ত হবে না, জীবন ধারণই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের বিভিন্ন অসুস্থতা ক্রমান্বরে কিডনী বিকলতায় রূপ নেয়, ফলে অকালে নিতে যায় লক্ষ লক্ষ সম্ভাবনাময় মানুষের জীবন প্রদীপ।কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের যেসব অসুস্থতা সাধারণত হয়ে থাকে তার বেশিরভাগেরই কারণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। এসব কারণ এড়িয়ে চললে কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের অসুস্থতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কিডনি রোগের জটিলতা
একটি কথা বিশেষভাবে সত্যি যে, কোনো ব্যক্তি যদি কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসক উপসর্গ লক্ষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তবে এ রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে নিরাময় ক’রে বা চিকিৎসা নিয়ে প্রায় স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন সম্ভব। অন্যদিকে, যদি প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের লক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে রোগ নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে সময়ের ব্যবধানে রোগ জটিল থেকে জটিলতর হয়, এমনকি কিডনী বিকল হয়ে পড়ে।
এ পর্যায়ে রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, আর চিকিৎসা-সুবিধা দেশে অপ্রতুলও বটে। এখন পর্যন্ত এসব চিকিৎসা (ডায়ালাইসিস বা কিডনী প্রতিস্থাপন) রাজধানী ঢাকাসহ দু’চারটে বিভাগীয় শহরে করা সম্ভব। কিন্তু এ-চিকিৎসা এতই ব্যয়বহুল যে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে এ-চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান প্রায় অসম্ভব।
কিডনি রোগ নির্নয়ের প্রয়োজনীয়তা
যেহেতু এ রোগের কারণগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জানা, তাই প্রতিরোধ পদ্ধতিও আমাদের আয়ত্তের ভেতরে এবং তা পালন করা সহজ ও সামান্য খরচেই সেটা সম্ভব।
কারো রোগ হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এসব রোগের নিরাময় রোগের পরিণতিকে ধীরগতিসম্পন্ন করা এবং কিডনী-বিকলতার মতো চূড়ান্ত অসুস্থতা সৃষ্টিকে প্রলম্বিত করা সম্ভব, যার ফলে রোগসৃষ্ট কষ্ট, দুর্ভোগ, অকালমৃত্যু এবং অসম্ভব ব্যয়বহুল চিকিৎসা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
এভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র দূর্বিসহ এসব অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা পেতে পারে এবং বিপুল চিকিৎসা ব্যয় বাঁচানো সম্ভবপর হতে পারে।
কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের গঠন
- কিডনী (প্রতিটি মানুষের দেহে দু’টি কিডনী আছে)
- কিডনী-টিউব
- প্রস্রাবের থলি
- প্রোস্টেট গ্রন্থি (শুধুমাত্র পুরুষের থাকে) মূত্রনালী
কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের কাজ
- শরীরে পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষা করা
- শরীরে সৃষ্ট বর্জ্য পদার্থ নিঃসরণে ভুমিকা রাখা।
- সুস্থ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কিছু হরমোন তৈরি করা।
- শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা।
- লোহিত কণিকা তৈরিতে সাহায্য করা।
- শরীরে এসিড ও ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করা।
কিডনী রোগের সম্ভাব্য কারণ
- শিশুদের নানারকম চর্মরোগ ও ত্বকের প্রদাহ।
- শিশুদের গলা/টনসিলের প্রদাহ।
- ডায়রিয়াজনিত কারণে শরীরে আকস্মিক পানিশূন্যতা।
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও তার জটিলতা।
- অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ও তার জটিলতা।
- মূত্রতন্ত্রের জন্মগত ত্রুটি ও জটিলতা।
- প্রস্রাবে ঘনঘন, দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ
- কিডনী, প্রস্রাবের থলি, প্রস্রাবের রাস্তায় পাথর হওয়া ও জটিলতা সৃষ্টি হওয়া।
- প্রস্রাব নির্গমণ পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া (প্রস্রাবের রাস্তা চিকন হওয়া, কিডনী থেকে প্রস্রাবের রাস্তায় যেকোনো স্তরে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া, প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড বড়-হওয়া)
- সন্তান প্রসব-সংক্রান্ত জটিলতা
- ব্যথানাশক ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা
- দূর্ঘটনাজনিত কারণে কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের জখম হওয়া বা কার্যক্ষমতা নষ্ট-হওয়া
কিডনী রোগের প্রাথমিক লক্ষণ
- ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া
- প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া
- প্রস্রাবে রক্ত-যাওয়া
- প্রস্রাবের সঙ্গে আমিষ নিঃসরণ
- কোমরের উপরে ব্যথা হওয়া।
- শরীর, বিশেষত মুখ ওপা ফুলে-যাওয়া।
- ক্ষুধামন্দা, বমিবমি ভাব বা বমি হওয়া
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
- অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ
- প্রস্রাব করার সময় বাধা অনুভব করা
- প্রস্রাব করতে না-পারা
- মূত্রতন্ত্রের কোনো স্তরে পাথরের উপস্থিতি প্রমাণিত হওয়া।
কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের রোগ নির্ণয়ে প্রাথমিকভাবে করণীয়
- রোগীর ইতিহাস জানা
- রোগীকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করা।
- প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা।
- প্রস্রাবের প্রদাহের কারণ নির্ণয়ের জন্য জীবাণু চিহ্নিত করার পরীক্ষা।
- কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের আলট্রাসনোগ্রাফি
- কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের এক্স-রে।
- রক্তে ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন-এর পরিমাণ নির্ণয়
কিডনি রোগ প্রতিরোধ! কিডনি সুস্ব্য রাখার উপায়!
- পরিমিত পানি পান করা।
- শিশুদের চর্মরোগজনিত ত্বকের প্রদাহের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক সময়ে যথাযथ চিকিৎসা করানো।
- সঠিক সময়ে টনসিল বা গলার প্রদাহের যথাযথ চিকিৎসা করা।
- প্রস্রাবে ঘনঘন প্রদাহ হলে কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
- উচ্চ রক্তচাপ ও বহুমূত্র রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং চিকিৎসকের পরামর্শমত সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করা।
- ব্যথানাশক ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার না করা।
- প্রস্রাব পরিত্যাগে বাধা অনুভূত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
- কিডনীতন্ত্রে পাথর থাকলে চিকিৎসা করানো এবং পাথর সৃষ্টির কারণ খুঁজে বের করে তার চিকিৎসা করা।
- খাদ্যে কৃত্রিম রঙের ব্যবহার পরিহার করা।
- খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থসহ খাদ্যদ্রব্যে সব কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ পরিহার করা।
- ধুমপানে বিরত থাকা।
- দূর্ঘটনাজনিত কিডনীতন্ত্রের জখমে সঠিকভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
- প্রস্রাবজনিত জটিলতায় সঠিকভাবে চিকিৎসা করানো।
- জন্মগত ত্রুটি জন্মের আগে থেকেই বা জন্মের পর যথাসম্ভব দ্রুত চিকিৎসা করানো।
উপসংহার
নির্দিষ্ট বয়সের পরে বছরে অন্তত একবার প্রস্রাব পরীক্ষা করানো এবং কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের আল্টাসনোগ্রাফি করানো।উল্লিখিত বিষয়ে আপনার সচেতনতা ও দৈনন্দিন জীবনে এগুলো মেনে চলা জীবনঘাতী কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের অসুস্থতা থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে।
লেখক
কাজী রফিকুল আবেদীন
আনোয়ারুল ইকবাল
Tag- কিডনি রোগ কিডনি রোগ কিডনি রোগ কিডনি রোগ কিডনি রোগ কিডনি সুস্ব্য রাখার উপায় কিডনি সুস্ব্য রাখার উপায় কিডনি সুস্ব্য রাখার উপায় কিডনি সুস্ব্য রাখার উপায়