গর্ভকালীন ডায়াবেটিস!গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!

সূচিপত্র-Table Of Contents
  1. গর্ভকালীন ডায়াবেটিস!গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!
  2. গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণ
  3. গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও ঔষধ

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস!গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!

একজন মহিলা গর্ভবতী হওয়ার পর তার শরীরে নানা রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসবের মধ্যে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational diabetes mellitus, GDM) অন্যতম । গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিস মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে যা মা ও গর্ভজাত শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।

অতীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৬০% মা শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে বা পরে মারা যেতেন।শতকরা ৩৩ ভাগ মারা যেতেন সন্তান জন্মের সময়, কারণ তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের জন্য কোনো উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলো না। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধ এবং ইনসুলিনের ব্যবহার মায়ের মৃত্যুহার অনেক কমিয়ে এনেছে। সেই সাথে শিশু মৃত্যুহারও কমেছে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস!গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!

আপনি আরও পড়তে পারেন … ডায়াবেটিক রোগীদের সুস্থ থাকার উপায়! …… খাবার কম খাওয়ার উপকারিতা! কম খান সুস্থ থাকুন!

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলতে আমরা কী বুঝি?

ডায়াবেটিস হচ্ছে আমাদের দেহের বিপাকীয় পদ্ধতির এক ধরনের সমস্যা। গ্রহণকৃত খাদ্য পরিপাকতন্ত্রের সাহায্যে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে। শরীরের মধ্যস্থ কোষকলা তখন প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় থেকে উৎপাদিত ইনসুলিন হরমোনের সাহায্যে গ্লুকোজ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে শরীরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।

যদি কোনো কারণে অগ্ন্যাশয় প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইনসুলিন উৎপাদন করতে না-পারে অথবা কোনো ত্রুটির কারণে কোষকলা ইনসুলিনের প্রতি অসংবেদনশীল হয়ে পড়ে তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। এ-অবস্থাতেই একজন ব্যক্তিকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

সচরাচর ডায়াবেটিস টাইপ-১ এবং টাইপ-২ এর কথা শোনা গেলেও আরো এক ধরনের ডায়াবেটিস আছে যাকে গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে ৩ থেকে ১০% কে এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

মহিলাদের ডায়াবেটিস

মহিলারা সাধারণত তিনভাবে ডায়াবেটিসে ভোগেন।যেমন-

  • ১. গর্ভধারণের আগে থেকেই কারোর ডায়াবেটিস
  • থাকতে পারে ফলে গর্ভাবস্থায়ও তাঁর ডায়াবেটিস অব্যাহত থাকে।
  • ২. কারো কারো হয়তো অগ্ন্যাশয়ের মাধ্যমে ইনসুলিন তৈরি হয় কিন্তু রক্তে ইনসুলিনের চাহিদা মেটায় না। ফলে তারা ডায়াবেটিসে ভোগে
  • ৩. কারো কারো শুধুমাত্র গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিস হয়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের পরবর্তীতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণ

গর্ভাবস্থায় নানা রকম হরমোন শরীরের বিপাক ক্রিয়ায় তারতম্যের সৃষ্টি করে। এজন্য অনেক মহিলার গর্ভধারণের পাঁচ থেকে সাত মাসের সময় ডায়াবেটিস দেখা দেয়। প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল থেকে উৎপন্ন কয়েক ধরনের হরমোন (কর্টিসল, প্রজেস্টেরন, হিউম্যান প্লাসেন্টাল ল্যাকটোজেন, প্রোল্যাকটিন, এস্ট্রাডিওল, ইত্যাদি) রক্তের ইনসুলিন হরমোনকে তার কাজে বাধা দেয়। এতে ইনসুলিন শরীরের বিভিন্ন কোষে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্লুকোজ সরবরাহ করতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এটিই গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের মূল কারণ।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি কোন মায়েদের

গর্ভকালীন সময়ে যেকোনো মায়ের ডায়াবেটিস হতে পারে, তবে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা বেশি থাকে যেমন-

  • প্রথম গর্ভধারণের সময় বয়স ২৫-এর বেশি থাকলে।
  • পরিবারে কারোর ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে।
  • কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস না থাকলে। অতিরিক্ত ওজন থাকলে (BMI ৩০ কেজি/বর্গমিটার এর উপরে)।
  • পেটের বেড়ের মাপ নিতম্বের বেড়ের মাপের চেয়ে বেশি থাকলে।
  • আগে মৃতশিশু প্রসব করে থাকলে বা প্রসবের পর শিশু মারা মারা গিয়ে থাকলে।
  • মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ধুমপানের অভ্যাস বা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম থাকলে।
  • আগের সন্তানের স্বাভাবিক প্রসবের সময় অসুবিধার সৃষ্টি হলে।

গর্ভবতী মা কীভাবে বুঝবেন তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে সাধারণত তেমন কোনো আলাদা লক্ষণ থাকে না ডায়াবেটিসের সাধারণ লক্ষণগুলোই দেখা যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝাপসা দৃষ্টি, ক্লান্তি, প্রস্রাবের থলি ও যোনিপথের ঘন ঘন সংক্রমণ, অতিরিক্ত তৃষ্ণা, অতিরিক্ত মূত্রত্যাগ, বমি বমি ভাব এবং বমি ও ক্ষুধা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়ার মতো কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নির্ণয়ের উপায়

গর্ভকালীন সময়ে মায়ের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে তা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হিসেবে গণ্য হয়। অর্থাৎ সকালে খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৬.১ মিলিমোল/লিটার (১১০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) বা তার চেয়ে বেশি অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘন্টা পরে ৭.৮ মিলিমোল/লিটার (১৪০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) বা তার চেয়ে বেশি হলে তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হিসেবে সনাক্ত করা হয়।এই পদ্ধতিকে বলা হয় OGTT (oral glucose tolerance test) I

আরেকটি পদ্ধতি আছে যাকে বলে GCT (glucose challenge test)। এই পদ্ধতিতে দিনের যেকোনো সময়ে (খালি বা ভরা পেটে) ৫০ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ১ ঘণ্টা পরে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৭.৮ মিলিমোল/লিটার (১৪০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) বা তার চেয়ে বেশি পেলে তাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হিসেবে ধরে নিতে হবে।

GCT পজিটিভ হলে অবশ্যই OGTT পরীক্ষাটি করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত ওজিটিটি পরীক্ষা করানো হয় শিশু গর্ভে আসার প্রায় ২০ সপ্তাহের মধ্যে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুনরায় ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে এই পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে মায়ের যেসব জটিলতা হতে পারে-

  • ১. গর্ভপাত
  • ২. গর্ভস্থ ভ্রূণের মৃত্যু
  • ৩. প্রসবের পূর্বে বা প্রসবকালীন সময়ে খিঁচুনি (প্রি-এক্লাম্পশিয়া ও এক্লাম্পশিয়া)
  • ৪. গর্ভস্থ পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
  • ৫. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা দুরূহ হয়ে ওঠা
  • ৬. গর্ভধারণের আগে চোখ বা কিডনির সমস্যা থকলে তা বেড়ে যাওয়া

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে শিশুর যেসব জটিলতা হতে পারে

  • ১. অস্বাভাবিক বেশি ওজনের শিশুর জন্ম ( ৪ কেজির বেশি) হওয়া
  • ২. কোনো কোনো ক্ষেত্রে গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি কম হওয়া
  • ৩. গর্ভবতীর রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকলে ভূমিষ্ঠ সন্তানের রক্তেও শর্করার পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। এর ফলে রক্তে বিদ্যমান অতিরিক্ত শর্করা প্রক্রিয়াজাত করে তুলতে শিশুর অগ্ন্যাশয়ের অতিরিক্ত ইনসুলিন উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর ফলে জন্মের সাথে সাথে শিশুর দেহে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিক নিচে নেমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে
  • ৪. রক্তের লোহিত কণিকা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া
  • ৫. জন্ডিস হওয়া
  • ৬. রক্তের ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম কমে যাওয়া
  • ৭. শ্বাসকষ্ট হওয়া
  • ৮. জন্মগত অঙ্গবিকৃতি হওয়া

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে করণীয়

  • রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা। এতে সন্তান হওয়ার সময় ঝুঁকি কম থাকে
  • নিয়মিত ব্লাড সুগার মাপা সম্ভব হলে দিনে ২-৩ বার।
  • যতটা সম্ভব পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়া।
  • বাড়ির সাধারণ কাজ করার পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাঁটা, সাঁতার কাটা কিংবা অন্য ব্যায়াম করার চেষ্টা করা
  • নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো।
  • গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় শুধুমাত্র ইনসুলিন ইঞ্জেকশন ব্যবহার করতে হবে। ডায়াবেটিসের মুখে খাওয়ার ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।
  • যাদের গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস ছিলো এবং মুখে খাওয়ার ওষুধ চলা অবস্থায় গর্ভধারণের কথা জানতে পেরেছেন, তাদেরও খাওয়ার ওষুধ বন্ধ করে ইনসুলিন শুরু করতে হবে
  • শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং মাঝারি ধরনের ব্যায়ামের মাধ্যমেই অনেকের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও ঔষধ

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন নেওয়া কেন জরুরি

এখনো গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাওয়ার ওষুধের নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত হয় নি। তবে যতটুকু জানা গেছে, মুখে খাওয়ার ওষুধ সাধারণত সফলভাবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং স্বাভাবিক ওজনের শিশুর জন্ম হয়।

এছাড়াও জন্মের সাথে সাথে শিশুর মারাত্মক হাইপোগ্লাইসেমিয়া রোধ করা সম্ভব হয় এবং পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে মায়ের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যায়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে কী ধরনের খাবার খেতে হবে

  • প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি খেতে হবে। দুপুর ও রাতের খাবারের সঙ্গে সালাদ খেতে হবে।
  • চিনিজাতীয় খাবারের পরিবর্তে অল্প পরিমাণে খেজুর, ডুমুর বা কিসমিস খাওয়া যেতে পারে।
  • মিষ্টি আলু বা আলুর মতো মূলযুক্ত সবজি খাওয়া যেতে পারে। খোসাসহ ভাপিয়ে নিলে পুষ্টিগুণ বজায় থাকবে।
  • লো-ফ্যাটযুক্ত দুধ ও দই খাওয়া উচিত।
  • গম, জোয়ার, খোসা সমেত চাল এবং ভুট্টার মতো গোটা দানা শস্য রান্না করে খাওয়া যেতে পারে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে কী ধরনের খাবার বর্জন করতে হবে।

  • গরু ও খাসির মাংস কম খেতে হবে। নিয়মিত যেকোনো প্রাণীর কলিজা না-খাওয়াই ভালো।
  • চিনিজাতীয় খাবার।
  • বেশি তেলযুক্ত খাবার।
  • সাদা চিনি, সাদা আটা, প্যাকেটজাত খাবার ও রেডিমেড সুপ না খাওয়াই ভালো।
  • কাঁচা লবণ খাওয়া উচিত নয়।
  • বিস্কুট, কেক, চকলেট ও আইক্রিম খাওয়া বন্ধ রাখা উচিত

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে ব্যায়াম

  • ১.ব্লাড সুগার লেভেল কম রাখার জন্য ব্যায়াম করা অত্যন্ত জরুরি। ওজন বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বেড়ে যায় তাই ব্যায়ামের মাধ্যমে যতটা সম্ভব ওজন কম রাখার চেষ্টা করা উচিত।
  • ২.এক এক জনের জন্য এক এক ধরনের ব্যায়াম কাজে লাগে। তাই কার জন্য কোন ধরনের ব্যায়াম উপকারী তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত। পিঠে বা অন্য কোনো জায়গায় ব্যথা হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যায়াম করা বন্ধ করে দিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
  • ৩.খেয়াল রাখতে হবে ব্যায়াম করার সময় হার্ট বিট যেন অস্বাভাবিক বেড়ে না যায়।

গর্ভবতী মায়ের ক্যালোরির চাহিদা

আদর্শ শরীরিক ওজন (বয়স ও উচ্চতার ওপর নির্ভর করে) অনুযায়ী প্রথম তিন মাস ৩০ কিলোক্যালোরি/কেজি, পরবর্তী তিন মাস ৩৬ কিলোক্যালোরি/কেজি এবং শেষ তিন মাস ৩৮ কিলোক্যালোরি/কেজি হিসেবে খাবার খেতে হবে।

খাদ্যে শর্করা (কার্বোহাইড্রেট) ৫০%-৬০%, চর্বি (ফ্যাট) ৩০% এবং আমিষ (প্রোটিন) ১০%-২০% থাকতে হবে। সাথে প্রয়োজনীয় আয়রন, ফলিক এসিড এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারও খেতে হবে ।

ধরা যাক, একজন মহিলার আদর্শ শরীরিক ওজন ৫২ কেজি। এমতাবস্থায় গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে প্রতিদিন তাঁর প্রয়োজন ৫২x৩০=১,৫৬০ কিলোক্যালরি খাদ্য। সেই হিসেবে দৈনিক শর্করাজাতীয় খাবার লাগবে ১,৫৬০x৫০% =৭৮০ কিলোক্যালরি, চর্বি জাতীয় ১,৫৬০×৩০% = ৪৬৮ কিলোক্যালরি এবং আমিষজাতীয় খাবার লাগবে ১,৫৬০x২০%=৩১২ কিলোক্যালরি। এভাবে পরবর্তী মাসগুলোর জন্য দৈনিক ক্যালোরির হিসাব করতে হবে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

সকালের নাস্তার আগে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫.৫ মিলিমোল/লিটারের নিচে এবং খাওয়ার পরে ৭.০ মিলিমোল/লিটারের নিচে থাকতে হবে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষার জন্য পরিচিত একটি পরীক্ষার নাম HbA1C এই পরীক্ষার সাহায্যে গ্লুকোজের মাত্রা দেখে নিতে হবে এবং এটি যাতে ৬.৫%-এর নিচে থাকে সেদিকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। রক্তচাপ (blood pressure) ১৩০/৮০ নিচে থাকতে হবে। গর্ভকালীন ওজন বৃদ্ধি ১০-১৫ কেজির মধ্যে আছে কি না তা লক্ষ্য রাখতে হবে।

নিজ বাসায় গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্তের গ্লুকোজ মাপার পদ্ধতি শিখে নেওয়া উচিত। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর থেকে নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হবে। অনেক সময় দিনে ছয় বার পরীক্ষা করা লাগতে পারে। সকালে খাবারের আগে ও পরে, দুপুরের খাবারের আগে ও পরে এবং রাতে খাবারের আগে ও পরে এই পরীক্ষা করতে হবে। কোনো সমস্যা দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

ডায়াবেটিস রোগীর সন্তান প্রসব-সংক্রান্ত সতর্কতা

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ফলে স্বাভাবিক প্রসবে কোনো বাধা নেই। যদি মায়ের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘস্থায়ী কোনো জটিলতা, প্রি-এক্লাম্পশিয়া থাকে বা গর্ভস্থ শিশুর ওজন বেশি অথবা গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি কম হওয়ার মতো কোনো সমস্যা দেখা যায় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের ১-২ সপ্তাহ আগেই স্বাভাবিক উপায়ে বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব করানো উচিত।

প্রসবের সময় মায়ের রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ৪.৫-৫ মিলিমোল/লিটারের (৮০-৯০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার) মধ্যে রাখতে হবে, অন্যথায় নবজাতকের গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিক নিচে নেমে গিয়ে বিপর্যয় ঘটাতে পারে।

শিশুর জন্মের আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুর গোড়ালি থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক আছে কি না। যদি গ্লুকোজের মাত্রা ২.২ মিলিমোল/লিটার (৪০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার)-এর নিচে থাকে তাহলে শিশুকে দ্রুত কোনো হাসপাতালের নিওনেটাল আইসিইউতে স্থানান্তর করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের শিশুর পরবর্তীতে স্থূলকায় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রসবের ছয় সপ্তাহ পর মায়ের রক্তের OGTT পরীক্ষা করতে হবে। স্বাভাবিক থাকলে প্রতি বছর কমপক্ষে একবার করে OGTT পরীক্ষা করতে হবে।

ডায়াবেটিস রোগীর সন্তান প্রসবের সময় যা করণীয়

  • ১. অভিজ্ঞ একজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ক্লিনিক বা হাসপাতালে প্রসব করাতে হবে
  • ২. শিশুকে ৪৮ ঘণ্টা নিওনেটাল কেয়ারে রাখা উচিত
  • ৩. প্রসবের আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধের উপায়

মনে রাখতে হবে ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। এটি প্রধানত বংশানুক্রমিক, তবে অনিয়মিত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও ডায়াবেটিস হতে পারে, বিশেষ করে অতিমাত্রায় চিনিজাতীয় খাবার, পানীয় ও কার্বোহাইড্রেট খেলে এবং কায়িক পরিশ্রমের কাজ না-করলে। তাই উপরোল্লিখিত লক্ষণগুলোর কথা মনে রেখে মাঝে মাঝে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত এবং আক্রান্ত হলে অবশ্যই সবসময় তা নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।

উপসংহার

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের সন্তানধারণ থেকে শুরু করে প্রসবের আগ পর্যন্ত সব সময়ই তাঁদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে তাদের গর্ভধারণের সময় বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তাদের এবং অন্যদের বেলায়ও গর্ভাবস্থায় অবশ্যই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিত। এছাড়া গর্ভকালীন পুরোটা সময় জুড়েই একজন মায়ের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত।

লেখক
ডাঃ রীনা দাস,
আইসিডিডিআর,বি