মানুষ অমর হতে পারে না কেন?

মানুষ অমর হতে পারে না কেন?

মৃত্যুর কথা শুনলেই মানুষের মনে অজানা একটি ভয় জেগে উঠে ভাবতে থাকে যদি মৃত্যু না থাকতো তাহলে কতই না ভালো হতো। এই রঙিন পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে মতদন চায়। কিন্তু মৃত্যুকে ফাঁকি দেয়ার কোন উপায় মানুষ আজ পর্যন্ত বের করতে পারে নি।

অনেক রূপকথার গল্পে মৃত্যুনাশকারী ইলিক্সার এর কথা শোনা যায়।এই ইলিক্সারের খোঁজে বহু রাজা বাদশা নিজেদের জীবন বাজি রেখে অনেক অর্থ ব্যয় করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত চষে বেরিয়েছেন কিন্তু বিধিবাম তাদের কেহই আজ বেঁচে নেই সবাই মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন।(মানুষ অমর হতে পারে না কেন?)

ইসলাম ধর্মের অনেক কিতাবের বর্ণনায় পাওয়া যায় খাঁজা খিজির আ: আবেহায়াত পান করে অমরত্ব লাভ করেছেন ফলে তিনি কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন। আবার হিন্দু ধর্মে দেবতারা অমরত্বের লোভে সমুদ্র মন্থন করেছেন। সেই অমৃত নিয়ে অসুরদের সাথে দেবতাদের বিকট যুদ্ধ হয়েছে। রূপকথার গল্পে এসব সম্ভব হলেও বাস্তব জীবনে আজ পর্যন্ত কেউ এই অমৃতের খোঁজ পায় নি যা পান করে অমরত্ব লাভ করবে।(মানুষ অমর হতে পারে না কেন?)

অনেকে খুবই নিষ্ঠার সাথে শরীর ঠিক রাখেন বহুদিন বাঁচার আশায় কিন্তু ফলাফল একই মৃত্যু ঠিক একদিন সবাইকে আলিঙ্গন করে। তাই আজ আসুন জেনে নিই  মানুষ কেন অমর হতে পারেনা তার কারণ….

মানুষ অমর হতে পারে না কেন?

আপনি আরো পড়তে পারেন…. মৃত্যু কী? মানুষ মলে কেন?

মানুষ কেন অমর হতে পারে না?

মানুষের অমরত্বের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে আমাদের ক্রোমোজোমের ঠিক শেষ প্রান্তে যাকে বলা হয় টেলোমিয়ার। টেলোমিয়ার বিষয়টি সবার কাছে পরিচিত নয় তাই আসুন সবার আগে এই বিষয়টি সহজভাবে বুঝে নেই।

মানবদেহ আসলে কয়েক ট্রিলিয়ন কোষ নিয়ে গঠিত। প্রতিটি কোষ নিয়ন্ত্রণ করে কোষের কেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াস মানুষের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য এক বংশ হতে অপর বংশে বহন করে। এই নিউক্লিয়াসের মধ্যেই আছে ক্রোমোজোম।ক্রোমোজোমের ভেতর থাকে দুই সুতা বিশিষ্ট DNA। প্রতিটি ক্রোমোজোম দেখতে লম্বা প্যাঁচানো  রশি বা দড়ির মত।প্রতিটি ক্রোমোজোমের দুটি বাহু থাকে। এই ক্রোমোজোমের ঠিক শেষ প্রান্তে DNA এর যে বিশেষ অংশটি রয়েছে তাকে বলা হয় টেলোমিয়ার। সহজ করে বললে বলা যায় ক্রোমোজোমের বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুই প্রান্ত কে টেলোমিয়ার বলে।

কোমোসোমের টেলোমিয়ার
টেলোমিয়ার

মানব দেহের প্রতিটি কোষে যেহেতু ৪৬ টি ক্রোমোজম আছে এবং প্রতিটি ক্রোমোজোমের দুটি বাহু থাকে সেহেতু মোট টেলোমিয়ারের সংখ্যা ৯২ টি।

টেলোমিয়ারের পরিচয় সম্পর্কে মনেহয় কিঞ্চিৎ ধারণা পেলেন তাহলে এবার এর কাজ সম্পর্কে জানতে হবে। টেলোমিয়ারের কাজ সহজে বোঝার জন্য এই ছোট গপ্পো টি মন দিয়ে শুনুন,
পাটের দড়ির শেষ মাথায় একটি গিট্টু দেয়া থাকে যাতে দড়ির পাঁক খুলে না যায়। ক্রোমোজোম গুলো দেখতে যেহেতু দড়ির মত সেহেতু এদের শেষ মাথায় গিট্টু দেয়া থাকে যাতে ভেতরের দুই সুতা বিশিষ্ট DNA প্যাঁচ খুলে একটির সাথে অপরটি যুক্ত হয়ে জটিল জাল সৃষ্টি করতে না পারে। অর্থাৎ টেলোমিয়ার আসলে আমাদের ক্রোমোজোমগুলিকে রক্ষা করে যাতে তারা প্যাঁচ খুলে পরস্পরের সাথে যুক্ত না হয়ে যায়।


যদি কোনো ক্রোমোজোমের টেলোমিয়ার না থাকে তাহলে তা কোষের বিভিন্ন ধরনের অস্বভাবিকতা সৃষ্টি করে এমনকি এটি ক্যান্সারের মতো রোগেরও কারণ হতে পারে।

প্রতিদিন প্রাণিদেহে অসংখ্য কোষের মৃত্যু ঘটে এই মৃত কোষগুলোর জায়গা পূরণ করতে নতুন কোষ সৃষ্টি হয়। আবার জীবের বৃদ্ধির জন্যও নতুন কোষ সৃষ্টি করতে হয়। পুরাতন কোষ বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করে। একটি পুরাতন কোষ থেকে যখন নতুন কোষ সৃষ্টি হয় তখন আসলে পুরাতন কোষের সবকিছু ফটোকপি হয় নতুন কোষে। এক্ষেত্রে ক্রোমোজোমেরও ফটোকপি হয়।(মানুষ অমর হতে পারে না কেন?)


ক্রোমোজোম ফটোকপি শুরু হয় মাঝখান থেকে শেষের দিকে। একটি কারিগর বা প্রাইমার খণ্ড সামনের দিকে যায় আর তার পেছনে নতুন খণ্ড সৃষ্টি হয়। এভাবে প্রাইমারের পেছনে নতুন খণ্ড তৈরি হতে হতে একসময় একটি পূর্ণাঙ্গ নতুন ক্রোমোজোম সৃষ্টি হয়। বিষয় টা বেশ সহজ মনে হচ্ছে তাই না!!!!

কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন প্রাইমার টেলোমিয়ারে পৌছে যায় তখন। কারণ টেলোমিয়ারের সামনে তো আর কিছু নেই তাই সামনের পথ বন্ধ আবার পেছনে নতুন খণ্ড এর মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে তাহলে টেলোমিয়ারের তো আর ফটোকপি হবে না  তার মানে নতুন যে ক্রোমোজোম খণ্ড ফটোকপি হলো তাতে টেলোমিয়ারের কিছু অংশ কম থাকে অর্থাৎ নতুন সৃষ্ট ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য পুরাতন ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা কম থাকে।(মানুষ অমর হতে পারে না কেন?)

এই নতুন কোষ যখন আবার বিভাজিত হবে তখন তার থেকে যে কোষ সৃষ্টি হবে তার ক্রোমোজোমের  দৈর্ঘ্য কম থাকবে। এভাবে একটা কোষ যতবার বিভাজিত হবে ততই তার ক্রোমোজোমের টেলোমিয়ার খাটো হতে থাকবে। আপনি জন্মের শুরুতে যে কোষগুলো নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা বারবার বিভাজিত হয়ে আপনার দেহকে বড় করেছে। আর প্রতিবার বিভাজনের সময় কোষে উপস্থিত ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য কমে যাবে।(মানুষ অমর হতে পারে না কেন?)

টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য কমতে কমতে এমন একটি ছোট অংশে পৌছাবে তখন আর ক্রোমোজোম একক দড়ির মত গঠনে থাকবে না, ক্রোমোজোমের ভেতরের সব উপাদান ছড়িয়ে যাবে ফলে বিভিন্ন অস্বাভাবিকতার কারণে কোষের মৃত্যু ঘটবে আর কোষের মৃত্যু ঘটলে প্রাণির ও মৃত্যু ঘটবে।

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে টেলোমিয়ার ক্ষয় হয়

আরো সহজ করে বললে হয়,
মনে করুন আপনি আপনার ঘরের মেঝের মাঝখানে  দাঁড়িয়ে চারপাশ থেকে বৃত্তাকারে  মেঝেটাকে রং করছেন। রঙ করতে করতে এমন এক সময় আসবে যখন আপনি যেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছেন সেই অংশটুকু আর রং করতে পারবেন না মানে নিজের জায়গাটা বৃত্তের কেন্দ্র হওয়ায় এটা আর রঙ করতে পারবেন না।(মানুষ অমর হতে পারে না কেন?)


এইভাবেই প্রতিবারের কোষ বিভাজনের সাথে সাথে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্যও ধীরে ধীরে কমতে থাকে আর একটা সময় আসে যখন কোষটির মৃত্যু ঘটে। আর এই টেলোমিয়ার দৈর্ঘ্য খাটো হয়ে যাওয়াই হলো বার্ধক্যের অন্যতম প্রধান কারণ।


ধরুন, আপনার জন্ম ২০০০ সালে। এখন আপনার বয়স ২২ বছর। ২০০০ সালে আপনি যে ক্রোমোজোমগুলো নিয়ে জন্মেছিলেন  আর আজ ২০২২ সালে যে ক্রোমোজোমগুলো আপনার কোষে আছে তার দৈর্ঘ্য ২০০০ সাল অপেক্ষা কম। টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য দেখে সঠিক বয়স নির্ণয় করা যায়।

ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মধ্যে টেলোমারেস নামে একটি উৎসেচকের উপস্থিতিতে এই টেলোমিয়ার এর দৈর্ঘ্য কমে না, বরং প্রতিবার যেটুকু ক্ষয় হয় তা পুনরায় ফিরে আসে। কিন্তু আমাদের দেহকোষের মধ্যে এই উৎসেচকের কর্মক্ষমতা খুবই কম। আর ঠিক এই কারণেই ডিম্বাণু বা শুক্রাণু অমর হলেও মানুষ অমর হতে পারে না।

মানুষের অমরত্ব কি সম্ভব নয়?


তাই যতই বয়স কমানোর ঔষধ সেবন,তারুণ্য ধরে রাখার খাবার গ্রহণ এবং বার্ধক্য রোধকারী ক্রিম মাখুন না কেন, বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখতে চাইলে টেলোমিয়ারকে ক্ষয় হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তাই বয়স্ক মানুষকে দেখলে অবশ্যই সম্মান করুন কারন তার ক্রোমোজোমের বয়স আপনার চেয়ে বেশি এবং আপনিও একদিন তার মত হবেন।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ওবেসিটি, স্ট্রেস, anxiety অথবা ধূমপান টেলোমিয়ার খাটো হওয়ার  এর এই পদ্ধতিকে যথেষ্ট ত্বরান্বিত করে।

মানুষ অমর হয়ে যাবে এটা ভাবলেই অদ্ভূত লাগে। কোনোকিছুর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই এরকম হলে হয়তো এই পৃথিবীর ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তার থেকে জন্ম মৃত্যু দুটোকে একসাথে নিয়ে চলার মধ্যে আনন্দ খোঁজাই হয়তো ঢের ভালো। অমর জীবনে কোন নতুনত্ব নেই সব একই রকম পানসে লাগবে। একঘেয়েমি জীবনের কারণে একসময় নিজেকে হত্যা করতে মন চাইবে।

ট্যাগ: মানুষ অমর হতে পারে না কেন?,মানুষ অমর হতে পারে না কেন?, মানুষ অমর হতে পারে না কেন? মানুষ অমর হতে পারে না কেন? তথ্যসূত্র: উইকিপেডিয়া

Please Click on Just one Add to help us

মহাশয়, জ্ঞান বিতরণের মত মহৎ কাজে অংশ নিন।ওয়েবসাইট টি পরিচালনার খরচ হিসেবে আপনি কিছু অনুদান দিতে পারেন, স্পন্সর করতে পারেন, এড দিতে পারেন, নিজে না পারলে চ্যারিটি ফান্ডের বা দাতাদের জানাতে পারেন। অনুদান পাঠাতে পারেন এই নম্বরে ০১৭২৩১৬৫৪০৪ বিকাশ,নগদ,রকেট।

এই ওয়েবসাইট আমার নিজের খরচায় চালাই। এড থেকে ডোমেইন খরচই উঠেনা। আমি একা প্রচুর সময় দেই। শিক্ষক হিসেবে আমার জ্ঞান দানের ইচ্ছা থেকেই এই প্রচেষ্টা। আপনি লিখতে পারেন এই ব্লগে। এগিয়ে নিন বাংলায় ভালো কিছু শেখার প্রচেষ্টা