- সিওপিডি কী? সিওপিডি কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!
- সিওপিডি তে কত মানুষ আক্রান্ত
- বাংলাদেশে কত মানুষ সিওপিডিতে আক্রান্ত
- সিওপিডি কী?
- COPD Full Form In Bangla
- সিওপিডি রোগের কারণ
- সিওপিডি রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ
- সিওপিডি রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
- সিওপিডি রোগের চিকিৎসা
- সিওপিডি রোগ প্রতিরোধের উপায়
- সিওপিডি রোগের ঔষধ
- সিওপিডি রোগ হলে করণীয়
- সিওপিডি রোগীর ব্যায়াম
- সিওপিডি রোগীর সুস্থ থাকার উপায়
সিওপিডি কী? সিওপিডি কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধ!
বিশ্বব্যাপী বর্তমানে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হলো সিওপিডি। আর ২০০০ সাল নাগাদ এটা হবে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। সিওপিডি শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত জটিল রোগ।বর্তমানে নারী ধূমপায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই চিত্র ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
আপনি আরও পড়তে পারেন …… ব্রংকাইটিস কী?ব্রংকাইটিসের কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা! …. এমফাইসিমা কী? এমফাইসিমার কারণ,লক্ষণ,চিকিৎসা ও প্রতিরোধ! …. ইনহেলার ব্যবহার এর নিয়ম!নেবুলাইজার ব্যবহার!
সিওপিডি তে কত মানুষ আক্রান্ত
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে আনুমানিক ৩০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ স্টাডি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী এই রোগে ৩১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি ১০ সেকেন্ডে COPD তে আক্রান্ত হয়ে একজন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। প্রকৃত সংখ্যা হয়তবা এর চেয়েও বেশি।
বাংলাদেশে কত মানুষ সিওপিডিতে আক্রান্ত
এক রিপোর্টে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ লোক COPD-তে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ COPD রোগে আক্রান্ত। যারা ধূমপান করেন তাদের মধ্যে এই সংখ্যা ১২ ভাগ এবং অধুমপায়ীদের মধ্যে ৩ ভাগ।
বিএসএমএমইউ’র এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে মানুষের ১১ দশমিক চার ভাগ COPD রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ১১ দশমিক ৭ ভাগ পুরুষ এবং ১০ দশমিক ৬ ভাগ নারী ।
সিওপিডি কী?
ফুসফুসের ভেতর অবস্থিত সূক্ষ্ম বায়ুনালি ও অ্যালভিওলাস ক্ষতিগ্রস্থ হলে শ্বাস নেয়ার সময় ফুসফুসে বাতাস প্রবেশে বাঁধা পায় ফলে শ্বাসকষ্ট হয় এই অবস্থা কে সিওপিডি বলে।
Wikipedia
COPD বলতে সাধারণত দুটো জিনিস বোঝায়-
১. ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, ২. এমফাইসিমা। যখন ফুসফুসে অবস্থিত বাতাসের থলিগুলোর বেশ কিছু দেয়াল নষ্ট হয়ে যায়। তখন এমফাইসিমা হয়। যেহেতু থলিগুলোর দেয়ালের মাধ্যমেই আমাদের রক্ত প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় সেহেতু এই দেয়ালের জন্য শরীর যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন পায় না। দীর্ঘদিন ধরে শরীরে অক্সিজেন কম থাকলে বা কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমে থাকলে বিভিন্ন অঙ্গের কর্মক্ষমতা কমে আসে।
COPD Full Form In Bangla
COPD এর পূর্ণরূপ হলো-
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ(Chronic Obstructive Pulmonary Disease)
সিওপিডি রোগের কারণ
COPD কেন হয় তার প্রধান উত্তর হলো দূষিত বাতাস গ্রহণ। এছাড়াও নিম্নোক্ত কারণে COPD হয়।
ক. ধূমপান
ধূমপান যত অল্প বয়সে করা হবে এবং প্রতিদিন যত বেশি সিগারেট পান করা হবে, ক্ষতি তত বেশি হবে। যেমন- যদি কেউ এক বছর ধরে দৈনিক ২০টি করে সিগারেট খায় তাহলে এটি হবে এক প্যাক ইয়ার। আর যদি ২০ বছর সিগারেট যায়, তাহলে হবে ২০ প্যাক ইয়ার সাধারণত COPD হতে ২০ প্যাক ইয়ার দরকার হয়। তারপর, যে যত বেশি ধূমপান করবে তার এটি তত বেশি হবে । যদি ৪০টি করে সিগারেট কনজ্যুম করে, তাহলে ১০ বছরের মধ্যে হয়ে যাবে।
খ. ঘরে ও বাইরের দূষণ
১.রান্নায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন-কাঠ, কয়লা, শুকনো পাতা,
ৰড়ি ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া
২. অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, কলকারখানা ও যানবাহনের উৎপন্ন ধোঁয়ায় বায়ু দূষণ, রাসায়নিক পদার্থ ও ধুলাবালি।
৩. মশা মারার কয়েলের ধোঁয়ার ছয় ঘণ্টা একটি মশার কয়েল জ্বললে তা প্রায় ১০০টি সিগারেটের সমান।
গ. কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণ দায়ী
COPD সম্পর্কে বুঝে সচেতন হওয়ার জন্য ফুসফুসের কাজ সম্পর্কে জানতে হবে। মানুষের বুকের ভিতরে হৃদপিণ্ডের দুই পাশে দু’টি ফুসফুস রয়েছে ।
ফুসফুস শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই শ্বাসযন্ত্রটির প্রধান কাজ হলো বাতাস থেকে অক্সিজেনকে রক্ত প্রবাহে নেয়া এবং রক্ত প্রবাহ হতে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বাতাসে নিষ্কাশন করা। এই গ্যাস আদান-প্রদান হয় বিশেষায়িত কোষ দ্বারা তৈরি খুবই পাতলা দেয়ালবিশিষ্ট লক্ষাধিক বায়ু থলির মাধ্যমে যাকে অ্যালভিওলাই ( Alveoli) বলে । COPD বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের ফলে এই থলিগুলোতে কম বাতাস যায়।
কেন বাতাস কম যায় তার নানাবিধ কারণ রয়েছে। যেমন-
- ১. থলি বা বাতাস যাওয়ার নালিগুলোর স্থিতিস্থাপকতা কমে গেলে।
- ২. থলিগুলোর কিছু দেয়াল নষ্ট হয়ে গেলে।
- ৩. নালিগুলোর দেয়াল মোটা হয়ে বাতাস প্রবাহের পথ সরু হয়ে গেলে
- ৪. নালিগুলোতে কফ জামে বাতাস যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হলে।
সিওপিডি রোগের উপসর্গ বা লক্ষণ
- ১. শ্বাসকষ্ট বা নিড ফর এয়ার হলো প্রথম লক্ষণ।
- ২. ক্রমাগত কাশি সেই সঙ্গে কফ।
- ৩. বুকের মধ্যে সোঁ সোঁ শব্দ।
- ৪. দম ফুরিয়ে যাওয়া, সিঁড়ি বা উঁচু জায়গায় ওঠানামার ক্ষেত্রে বুকে চাপ অনুভব করা বা শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া।
- ৪. বুক হালকা লাগা।
- ৫. সবসময় ক্লান্ত লাগা, অরুচি, দুশ্চিন্তা, শরীরে পানি জমতে পারে, হাড় ক্ষয় ইত্যাদি হতে পারে।
বেশিরভাগ মানুষ শুরুতে এই শ্বাসকষ্টকে পাত্তাই দেয় না। সাধারণ সর্দি-কাশি বা ধূমপানের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে ধরে নেয়। কিন্তু, সাধারণ কাশি দিয়ে শুরু হলেও কিছুদিনের মধ্যে তা দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগে আকার, নেয়।
আর এই রোগে একবার আক্রান্ত হলে রোগী ধীরে ধীরে খারাপের দিকেই যায় এবং কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এমনকি হাঁটাচলা করাও কঠিন হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ৫০ শতাংশ সিওপিডি রোগী সনাক্তের বাইরে থাকে এবং তারা পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন।
সুতরাং, এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে বুঝাতে পারবেন ভিতরে কত পরিমাণ অক্সিজেন কম ঢুকছে বা শ্বাসনালির কতটা সঙ্কোচন হচ্ছে।
সিওপিডি রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ক) বক্ষব্যাধির সমস্যা নির্ণয় করতে
- ১. বুকের এক্স-রে।
- ২. স্পাইরোমেট্রি।
- ৩. রক্ত ও কাশির পরীক্ষা।
- ৪. বুকের সিটিস্ক্যান।
খ) COPD রোগের কারণে রক্তনালি না হয় এবং এতে রক্তচাপ বেড়ে যায়। ফলে হৃদপিণ্ডের জ্ঞান প্রকোষ্ঠে চাপ বাড়ে। তাই, হৃদপিণ্ডের অবস্থা জানতে করা হয়
- ১. ইসিজি,
- ২. ইকো কার্ডিওগ্রাফি ।
সিওপিডি রোগের চিকিৎসা
এই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল হয় না। চিকিৎসা হলো উপসর্গকে কিছুটা প্রশমিত রাখা এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস নিয়ন্ত্রণ করা। তাই প্রতিরোধই সর্বোত্তম পন্থা।
রোগীর শরীর অন্য কোনো রোগ যেমন-ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, দুশ্চিন্তা-হতাশা, ঘুমের সমস্যা, অ্যাসিডিটি প্রভৃতি থাকলে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
সিওপিডি রোগ প্রতিরোধের উপায়
- ১. ধূমপান ও পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে। নিজে ধূমপান করবেন না এবং অন্যকে ধূমপান করতে দিবেন না। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে COPD -তে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন হ্রাস পাবে তেমনিভাবে স্বাস্থ্যখাতের ব্যয়ও অনেকটা কমে আসবে । ধূমপান নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ধূমপায়ীদের নেশার জগত থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সহজ হবে।
- ২. পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে ।
- ৩. ধোঁয়া-ধুলা এড়াতে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
- ৪. স্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
- ৫. দৈনিক খাবারের পাঁচভাগ ফল ও সবুজ শাক সবজি খেতে হবে। যা COPD-তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
- ৬. প্রতি বছর একবার ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন এবং প্রতি ৩০ বছরে একবার নিউমোনিয়ার ভ্যাক্সিন নেয়া যেতে পারে।
সিওপিডি রোগের ঔষধ
চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী শ্বাসনালী প্রসারিত হয় এমন ব্রঙ্কোডায়েলেটর, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের নিয়মিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। ঔষধ গ্রহণের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে ইনহেলার ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
সিওপিডি রোগ হলে করণীয়
কখনও ইনফেকশন বা অ্যালার্জিজনিত কারণে উপসর্গগুলো বেড়ে গেলে যেমন-হঠাৎ শ্বাসকষ্ট, কফের পরিমাণ বেড়ে গেলে, কফের রং পরিবর্তন হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ইনফেকশন ফুসফুসকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ঋতু পরিবর্তনের সময় অনেকের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে রোগীকে সচেতন থাকতে হবে। প্রয়োজনে বাড়িতে অক্সিজেন নেয়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে মেশিনের সাহায্যে শ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করা ।
সিওপিডি রোগীর ব্যায়াম
পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন বা ফুসফুসের পুনর্বাসন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করে ফুসফুস ও শ্বাস-প্রশ্বাসের মাংসপেশীগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, শরীরের মাংসপেশী নমনীয় ও প্রসারিত করার ব্যায়াম, কাঁধের ব্যায়াম, পায়ের ব্যায়াম করতে হবে।
সিওপিডি রোগীর সুস্থ থাকার উপায়
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস, রোগ সম্পর্কে ধারণা প্রদান, ছোট ছোট সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে শেখানো, বিকল্প জীবিকা সম্পর্কে ধারণা ইত্যাদি সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি করা।
ফুসফুসের শক্তি কমে যাওয়ায় যাদের মধ্যে রোগের উপসর্গের উপস্থিতি বেশি এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসা গ্রহণ করেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না অর্থাৎ, শারীরিক অক্ষমতায় ভুগছেন, তারা পালমোনারি রিহ্যাব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে বেশি উপকৃত হবেন। পালমোনারি রিহ্যাবের মাধ্যমে রোগীর মনে বাঁচার নতুন আশা জেগে ওঠে।
লেখক
ডা. মনিরুজ্জামান খান
মেডিকেল অফিসার, চিকিৎসা কেন্দ্র, ঢাকা