পরজীবীঘটিত ডায়রিয়া কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়া কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

ডায়রিয়ার সাথে আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত পরিচিত। তবে আমরা হয়তো অনেকেইে জানি না যে ডায়রিয়া সৃষ্টির জন্য দায়ী তিন ধরনের জীবাণু- ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস এবং পরজীবী বা প্যারাসাইট।যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা এসব পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়, প্রাপ্তবয়স্করাও এর হাত থেকে রেহাই পায় না। প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকেই পেট মোচড়ানো বা আঠালো মল হয় এমন অভিযোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এসে থাকেন।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়া কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

আপনি আরও পড়তে পারেন … উচ্চমাত্রার জ্বর,খিঁচুনি, নাক দিয়ে রক্ত-পরার প্রাথমিক চিকিৎসা …… শিশুর নাভীতে ঘাঁ ও নাভী পাকা!টিনিয়াসিস রোগ কী? …… এলার্জিক রাইনাইটিস কী? …… অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলত্ব সমস্যা!

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার জীবাণুর নাম

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার জীবাণুর নাম

এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা, জিয়ারডিয়া এবং – ক্রিপটোসপোরিডিয়াম — এই তিন ধরনের পরজীবীই অস্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং ডায়রিয়ার জন্য দায়ী।এন্টামিবা পরজীবী অনেক ক্ষেত্রে লিভার (যকৃত)-এর অ্যাবসেস বা লিভারে গভীর ক্ষত তৈরি করে, যার ফলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। তাই এসব পরজীবী সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার জীবাণুর বিবরণ

এন্টামিবা

বাংলাদেশে এসব পরজীবীর প্রাদুর্ভাব নির্ণয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তার বেশিরভাগই হয়েছে আইসিডিডিআর,বি-তে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দেখা যায়, ঢাকার মিরপুর বস্তি এলাকায় দুই থেকে পাঁচ বছর-বয়সী ৬৮০ জন শিশুর মধ্যে ৫% এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকায় আক্রান্ত ছিলো,যদিও তাদের কারোর মধ্যেই রোগের কোনো লক্ষণ ছিলো না। ২০১৩ সালে প্রকাশিত আরেক গবেষণায় দেখা যায়, আইসিডিডিআর,বি-র ঢাকা হাসপাতালে ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আসা ৫১,৯৯৯ জন রোগীর মধ্যে ১%-এর দেহে এন্টামিবা ছিলো।

এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা-র ক্ষেত্রে ধারণা করা হয় যে, পৃথিবীর প্রায় ১০% মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত । তবে এই ১০% মানুষের ৯০% ক্ষতিকারক নয় এমন এন্টামিবা (এন্টামিবা ডিসপার)-এর দ্বারা আক্রান্ত। তবে সমস্যার কথা হলো, ক্ষতিকর এন্টামিবার ৯০% সংক্রমণ বা ইনফেকশনই লক্ষণ প্রকাশ করে না, যাকে বলে অ্যাসিম্পটমেটিক ইনফেকশন। এটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা এবং বলা হয় যে প্রতিবছর এ রোগে প্রায় ৪০ হাজার থেকে এক লক্ষ মানুষ মারা যায়।

জিয়ারডিয়া

আইসিডিডিআর,বি-র অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায় ২,৫৩৪ জন ডায়রিয়া রোগীর ৭.৭% জনের মধ্যে জিয়ারডিয়া পাওয়া গেছে। ২০১১ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের একটি যৌথ গবেষণায় ২৬৬ জন শিশুর মধ্যে ৩.৮% জনের দেহে জিয়ারডিয়া পাওয়া
যায়।

ক্রিপটোসপোরিডিয়াম

২০০৬-২০০৭ সালে আইসিডিডিআর,বি-র ঢাকা হাসপাতালে ৫৪০ জন রোগীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় ৪.৪% জনের মধ্যে ক্রিপটোসপোরিডিয়াম পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশের অন্য স্থানে এ রোগের প্রাদুর্ভাব-সংক্রান্ত তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার লক্ষণ

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গেলে তিনটি পরজীবী আলাদা আলাদা ভাবে বলাই ভালো। যদিও এদের অনেকগুলো লক্ষণেই মিল পাওয়া যায়, তবে এই তিন পরজীবীর লক্ষণ প্রকাশে কিছু সুনির্দিষ্ট ভিন্নতাও রয়েছে।

এন্টামিবা

এই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার পর এক থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। এদের মধ্যে কারোর খুব সামান্য, কারোর মাঝারি এবং কারোর ভয়াবহ সংক্রমণ দেখা দেয়। লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে-

  • কম মাত্রার ডায়রিয়া এবং ডায়রিয়ার সাথে রক্ত ও আঠালো মল। এই অবস্থা মূলত ডিসেন্ট্রি নামে পরিচিত।
  • এসব ছাড়াও এই পরজীবী যকৃত বা লিভারে বাসা বাঁধতে পারে। যকৃতে বাসা বাঁধলে সাধারণত ডায়রিয়া হয় না তবে শরীরে জ্বর আসে ও পেটে প্রচণ্ড ব্যথা বা মোচড়ানো ভাব থাকে।

জিয়ারডিয়া

জিয়ারডিয়া-র সংক্রমণে ডায়রিয়া হয় পানির মতো। জিয়ারডিয়ায় আক্রান্ত রোগের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ:

  • শরীর দুর্বল হওয়া
  • খাবারে অরুচি
  • পানির মতো মল
  • পেট মোচড়ানো

এসব লক্ষণ সংক্রমণের দিন থেকে শুরু করে ৯-১৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক ক্ষেত্রে জিয়ারডিয়ার সংক্রমণের লক্ষণ বোঝা যায় না। জিয়ারডিয়া সাধারণত ক্ষুদ্রান্ত্রে বাসা বেঁধে দেহের পুষ্টিকণা শোষনে বাধার সৃষ্টি করে।

ক্রিপটোসপোরিডিয়াম

এটি মূলত খুবই স্বল্পস্থায়ী ডায়রিয়া। ক্ষুদ্রান্তে প্রবেশ করে সংক্রমণ সৃষ্টির পর থেকে প্রায় ৭ দিন পর্যন্ত এর লক্ষণ থাকতে পারে।

  • এই ডায়রিয়াতেও এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকার মতো মল আঠালো হয়ে থাকে এবং পেট ব্যথা করে।
  • কোনো কোনো সময় শরীরে হালকা জ্বরও থাকে। এ রোগে দেহে পানিশূতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়।
  • ক্যান্সার বা এইডস আক্রান্ত রোগী যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগে থেকেই দুর্বল তাদের অনেককে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার জীবাণু কীভাবে ছড়ায়

এসব পরজীবী মূলত নোংরা পরিবেশ, বাসি খাবার, দূষিত পানি, প্রভৃতির মাধ্যমে ছড়ায়। শিশুদের নোংরা ডায়াপার থেকেও এসব পরজীবী (বিশেষ করে ক্রিপটোসপোরিডিয়াম) ছড়াতে পারে। জিয়ারডিয়া স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে তিন মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমেছে, তবে এখনও অনেক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার রোগনির্ণয়

সাধারণত ল্যাবরেটরি-তে মল পরীক্ষা করে এসব পরজীবী নির্ণয় করা হয়।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার চিকিৎসা

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার চিকিৎসা বিভিন্ন পরজীবীভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে। এসব চিকিৎসা গ্রহণ করার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে, প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিচে কিছু চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার ঔষধ

এন্টামিবা দ্বারা সংঘটিত ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে।

সাধারণত অন্ত্রে বা অস্ত্রের কোষে অথবা যকৃতে এন্টামিবার সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। গ্যাস্ট্রোইনটেসটাইনাল এমিবিয়োসিসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত মেট্রোনিডাজল বা টিনিডাজল গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেটি রক্তের মধ্যে বিদ্যমান এন্টামিবাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। পাশাপাশি অন্ত্রের গাত্রে এবং যকৃতের মধ্যে বিদ্যমান এন্টামিবাকেও ধ্বংস করতে পারে এই ওষুধটি।

সাধারনত ১০ দিন পর্যন্ত মেট্রোনিডাজল ব্যবহার করতে হয়। পুরো অস্ত্রের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত লুমিনাল ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যেটি পুরো অস্ত্রজুড়ে এমিবাকে ধ্বংস করে। লুমিনাল ওষুধ তিনটি ওষুধের সমন্বয়ে হয়ে থাকে – আয়োডোকুইনল, প্যারোমাইসিন এবং ডিলোক্লানাইড ফিউরয়েট। যাদের নিয়মিত পায়খানার সাথে এমিবা যায় কিন্তু এমিবায়োসিসের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না তাদের ক্ষেত্রেও লুমিনাল ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

জিয়ারডিয়া দ্বারা সংঘটিত ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে:

জিয়ারডিয়া চিহ্নিত হলে সাধারণত তিনটি অতিপরিচিত ওষুধ দিয়ে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে, সেগুলো হলো— মেট্রোনিডাজল, টিনিডাজল এবং ফিউরাজোলিডন।

ক্রিপটোসপোরিডিয়াম দ্বারা সংঘটিত ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে:

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা ছাড়া ক্রিপটোস পোরিডিয়াম-এর দ্বারা সংঘটিত ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়। ডায়রিয়া থেকে সহজেই সুস্থ হওয়া যায় যদি ডায়রিয়া হওয়ার সাথে সাথে সঠিকভাবে স্যালাইন গ্রহণ করা হয়। তবে যেকোনো পরজীবী দ্বারা সংঘটিত ডায়রিয়াই হোক না কেন তা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে অবশ্যই রেজিস্টার্ড/বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।

পরজীবীঘটিত ডায়রিয়ার প্রতিরোধ

শরীরের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্যাস্ট্রোইনটেসটাইনাল এমিবায়োসিস প্রতিরোধ করতে পারে না। সেজন্যে আমাদের কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার, যেমন বিশুদ্ধ পানি পান করা, বাসি খাবার পরিহার করা, ফলমূল খাওয়ার আগে ভালো করে ধুয়ে খাওয়া এবং খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। এসব পরজীবী প্রতিরোধ করার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয় নি।

নিজে সচতেন থেকে অপরকে সচেতন করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে সহজেই এসব পরজীবী থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। এ-ব্যাপারে দেশবাসীকে সচেতন করে তোলার জন্য সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সেই সাথে দেশব্যাপী এসব পরজীবীর প্রাদুর্ভাবের হার নির্ণয় করা খুবই জরুরী, যা ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারকে সাহায্য করবে।

চৌধুরী মোঃ গালিব, আইসিডিডিআর,বি
তাসনীম আহমেদ, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল লিঃ