শিশুর ফুসফুসের রোগ ও তার প্রতিকার!

সূচিপত্র-Table Of Contents
  1. শিশুর ফুসফুসের রোগ ও তার প্রতিকার!
  2. শিশুর ফুসফুসের রোগ নিউমোনিয়া
  3. শিশুর ফুসফুসের রোগ ব্রংকিওলাইটিস

শিশুর ফুসফুসের রোগ ও তার প্রতিকার!

প্রতিবছর উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন শিশু ফুসফুসের বিভিন্ন রোগে মৃত্যুবরণ করে। এই সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় প্রায় সাতগুণ বেশি।

শিশুর ফুসফুসের রোগ ও তার প্রতিকার!

আপনি আরও পড়তে পারেন …… শিশুদের ইনহেলার ব্যবহারের নিয়ম! ….. শিশুর অ্যাজমা এটাক প্রাথমিক চিকিৎসা!নবজাতকের নাভীর প্রদাহ!শিশুর নাভীতে ঘাঁ ও নাভী পাকা!মৃগীরোগ বা এপিলেপ্সি কী?…. রুবেলা রোগ কী?

শিশুর ফুসফুসের রোগের নাম

শিশুর ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের মধ্যে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, হুপিং কাশি, ব্রংকিওলাইটিস, ইত্যাদি বেশি হতে দেখা যায়।

শিশুর ফুসফুসের রোগের কারণ

শিশুর ফুসফুসের রোগ মুলত যেসব জীবাণু দ্বারা সংঘটিত হয় তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া অন্যতম।শিশুর ফুসফুসের রোগের প্রধান প্রধান ভাইরাস জীবাণুগুলো হচ্ছে

  • Respiratory syncitial virus Adenovirus
  • Parainfluenza virus
  • Rhinovirus
  • Influenza virus,

শিশুর ফুসফুসের রোগের ব্যাক্টেরিয়াজাতীয় জীবাণুগুলো হচ্ছে

  • Streptococcus pneumoniae
  • staphylococcus aureus
  • Streptococcus pyogenes
  • Escherichia coli
  • Salmonella

অন্যান্য যেসব জীবাণু শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের জন্য কদাচিৎ দায়ী সেগুলো হলো

  • Mycobacterium tuberculosis Chlamy dia
  • Trachomonas
  • pneumocystis carini
  • Mycoplasma pneumoniae

শিশুর ফুসফুসের রোগের পরিবেশীয় কারণ

শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের জন্য কিছু কিছু পরিবেশগত কারণও মুখ্য হয়ে উঠতে পারে, যেমন অতিরিক্ত ঘনবসতি ও বড় পরিবার। অপুষ্টি, বিশেষত ভিটামিন এ’র ঘাটতি, কম জন্ম ওজনসম্পন্ন শিশু, পরিবেশ দূষণ, মাতাপিতার ধুমপানজনিত কারণ ( Parental smoking)। যেসব শিশুর কিছু বিশেষ রোগ আছে (Bown’s syndrome, VSD) তাদের শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি।

মূলত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের বিস্তার ঘটে এমন একটি ধারণা আগে প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে জানা যায় যে, প্রদাহসম্পন্ন স্থানের স্পর্শে আসা হাত থেকেও রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে।

শিশুর ফুসফুসের রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ

  • শিশুর ফুসফুসের রোগ মূলত লক্ষণ দ্বারা সনাক্ত করা যায়, যেমন-
  • ঘনঘন কাশি হয়
  • শিশু রাতে খুব কাশে
  • গায়ে জ্বর থাকে
  • খাবার গিলতে অসুবিধা হয়
  • বুকের ভেতর কবুতরের ছানার মত চিচি শব্দ হয়
  • শিশু খেতে চায়না
  • কানের প্রদাহজনিত রোগে কান থেকে পূঁজ নিঃসরণ।
  • হঠাৎ কানে ব্যথা হওয়া।
  • লাল হয়ে যাওয়া টনসিলের প্রদাহের ক্ষেত্রে গলা-ব্যথা।
  • ঢোক গিলতে কষ্ট হওয়া এসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

শিশুর ফুসফুসের রোগের চিকিৎসা

মূলত উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা কমপক্ষে ৫ দিন চিকিৎসা করলে এ-রোগ থেকে মুক্তি লাভ করা যেতে পারে।

শিশুর ফুসফুসের রোগ নিউমোনিয়া

নিউমোনিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগ। মূলত এসব রোগীর কাশি ও শ্বাসকষ্টের পূর্ব ইতিহাস থাকে।

কিভাবে বুঝবেন শিশুর নিউমোনিয়া হয়েছে?

দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস এবং বুকের পাঁজর ওঠানামা দ্বারা নিউমোনিয়া সনাক্ত করা যায়। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস বয়স অনুযায়ী নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়:

২ মাসের নিচে মিনিটে ৬০ বারের অধিক শ্বাস প্রশ্বাস নিলে
২ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত: মিনিটে ৫০ বারের অধিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে
১ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত: মিনিটে ৪০ বারের অধিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-প্রদত্ত নীতিমালা দ্বারা নিউমোনিয়া রোগ খুব সহজে সনাক্ত করা যায়। নিচে বয়সভেদে তা বর্ণনা করা হলো:

এই নীতিমালা অনুযায়ী ২ মাসের নিচের শিশুদের জন্য রোগকে দুই পর্যায়ে ভাগ করা যায়:

ক. নিউমোনিয়া নয় এমন কফ-কাশি
খ. মারাত্মক নিউমোনিয়া।/অতি মারাত্মক নিউমোনিয়া

ক. নিউমোনিয়া নয় এমন কফ-কাশি হলে কোনো ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো এবং বাচ্চাকে গরম রাখাই এর চিকিৎসা। তবে শ্বাসকষ্ট হলে, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে, বুকের পাঁজর ভাঙলে বা বাচ্চা বুকের দুধ খেতে না পারলে সত্বর ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

খ. মারাত্মক নিউমোনিয়া/অতি মারাত্মক নিউমোনিয়া হলে লক্ষণগুলো হলো

(১) বাচ্চা বুকের দুধ ভালোভাবে খেতে পারবে না।
(২) শরীরের তাপমাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি বা হ্রাস পাবে
(৩) দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিবে (মিনিটে ৬০ বারের অধিক)
(৪) বুকের পাজর উঠানামা করবে
(৫) চেহারা নীলবর্ণ ধারণ করবে
(৬) খিঁচুনি দেখা দিতে পারে এবং
(৭) বাচ্চার শ্বাস মাঝেমাঝে বন্ধ হয়ে যাবে।

মারাত্মক নিউমোনিয়ার চিকিৎসা

ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে, উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক (Benzyl penicillin ও Gentamicin) দ্বারা রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে অক্সিজেন দিতে হবে।

২ মাস থেকে ৫ বছর-বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে রোগকে চার পর্যায়ে ভাগ করা যায় :

  • ক. নিউমোনিয়া নয় এমন সর্দি-কাশি
  • খ. নিউমোনিয়া
  • গ. মারাত্মক নিউমোনিয়া
  • ঘ.অতি মারাত্মক নিউমোনিয়া

ক. নিউমোনিয়া নয় এমন সর্দি-কাশি শুধুমাত্র সাধারণ কাশির জন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই, লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে।

খ. শিশুর নিউমোনিয়া

লক্ষণ : রোগী দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিবে (২ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত মিনিটে ৫০ বারের অধিক, ১ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত মিনিটে ৪০ বারের অধিক), কিন্তু বুকের পাঁজর ভাঙবে না।

চিকিৎসা

Amoxycillin, Cotrimoxazole দ্বারা চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় এর চিকিৎসা করা সম্ভব, কিন্তু রোগীর অবস্থার অবনতি হলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হবে।

গ. শিশুর মারাত্মক নিউমোনিয়া

লক্ষণ: বুকের পাঁজর ভেঙে আসবে।

চিকিৎসা: উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক (Benzyl penicillin) দ্বারা চিকিৎসা করতে হবে।

ঘ. শিশুর অতি মারাত্মক নিউমোনিয়া

লক্ষণ:রোগী পানি পান করতে পারবে না, রোগীর শরীর নীলবর্ণ ধারণ করবে।

চিকিৎসা: ক্লোরামফেনিকল (Chlorampheni col) অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হবে।

শিশুর ফুসফুসের রোগ ব্রংকিওলাইটিস

শিশুর ব্রংকিওলাইটিস রোগ কী? ব্রংকিওলাইটিসের কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

ছয় মাস থেকে আঠারো মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে Bronchiolitis নামের রোগ দেখা যায়। Respiratory syncitial virus এ রোগের মূল কারণ। এ-রোগের লক্ষণ হলো

  • (১) হঠাৎ কাশি ও শ্বাসকষ্ট।
  • (২) বুকের খাঁচা ভেঙে যাওয়া।
  • (৩) জ্বর থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।
  • (৪) খাওয়া কষ্টকর হয়ে যেতে পারে।

এই লক্ষণ সত্ত্বেও শিশু প্রায়ই হাসিখুশি এবং ভালো থাকে।

শিশুর ফুসফুসের রোগ- শিশুর ব্রংকিওলাইটিস রোগ কী? ব্রংকিওলাইটিসের কারণ,লক্ষণ ও চিকিৎসা!

শিশুর ব্রংকিওলাইটিস রোগের চিকিৎসা

যদিও অ্যান্টিবায়োটিকের তেমন কোনো প্রয়োজন নেই (কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাইরাস এ রোগের কারণ) তবুও শিশুর যদি জ্বর থাকে বা শ্বাসকষ্ট অত্যধিক হয়, তবে অ্যান্টিবায়োটিক অনেক সময় ব্যবহার করা হয়।

শিশুর ফুসফুসের রোগ ব্রংকিয়াল অ্যাজমা

এ রোগে বিশেষ কিছু পরিবেশজনিত অবস্থার প্রতি শ্বাসনালীর সংবেদনশীলতার কারণে বায়ুপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। এ-রোগে সাধারণত কাশি, শ্বাসকষ্ট, গলায় শা শা শব্দ, ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। সাধারণত যেসব বিষয়ের প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে এ রোগ হতে পারে সেগুলো হলো-

  • (১) বিভিন্ন প্রকার ধূলাবালি
  • (২) কলকারখানা ও সিগারেটের ধোঁয়া, (৩) খাদ্যদ্রব্য, যেমন গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, ইত্যাদি।
  • অনেক ক্ষেত্রে বংশগত অ্যাজমার ইতিহাসও দেখা যায়।
  • যেসব শিশুর ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট হয়, প্রায়ই শুকনা কাশি দেখা যায়, অ্যালার্জি থাকে, বংশের কারো অ্যাজমা রোগের ইতিহাস থাকে, তাদের এ রোগের সম্ভাবনা সর্বাধিক।

শিশুর ব্রংকিয়াল অ্যাজমা চিকিৎসা

লক্ষণ বুঝে Bronchodilator (Salbutamol theophyllin), প্রদাহ নিবা-রণকারী ওষুধ (Sodium chronoglycate, steroid), ইত্যাদি দ্বারা অ্যাজমার চিকিৎসা করা হয়।

লেখক- সায়েমা খোরশেদ
আইসিডিডিআর,বি